তারপর আর কখনো দেখা হয়নি তার সাথে...
সাধারনত আমার ট্যাক্সির পাশের সিটটা বেমালুম খালিই পরে থাকে।"লম্বে এক সাওয়রি পে" হাতে হাত রাখার ফুরসৎ কিমবা অধিকার কোনোটাই নেই অামার।সামনের বসার জায়গায় এখন শুধু মবিল পোড়া গন্ধ পাই।ইঞ্জিনের তাপ ঠিকরে এসে বুকের মাঝখানটা লাগে।আমার একটা হাতে স্টেয়ারিং ঘোরাচ্ছি মানে অন্যহাতটা নিশ্চিত ঠোঁটের নীচে জমে থাকা সারাদিনের ক্লান্তির ঘাম মুছে নিচ্ছে।ব্যস্ত এই শহরে ট্র্যাফিক জ্যামে যাতে না ফেঁসে যাই সেই আশঙ্কায় সিগনালে দাঁড়িয়ে কাঁচ নামিয়ে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলি।একবার ইলেকট্রনিক মিটারের নামতা পরা দেখি,আর একবার তাকাই পাশের সেই শূন্যতায়...এখনো ওটা বেশ ঝাঁ চকচকেই রয়েছে,তবু বার কয়েক ঝেড়ে মুছে রাখি।এনগেজ তো থাকে ব্যাকসিটটা।ওই সিটটা আজ অবধি কতো জাতের যে রক্ত মাংসের ছাপ বহন করেছে তার হিসেব করিনি।জাত মানে হিন্দু মুসলিম খ্রীষ্টান নয়...ও আমার যাত্রীদের ছোট সফরে মাথা হেলিয়ে চোখ বুঁজে ক্ষণিক মুহূর্তে ভিড় করা হাজারো গোপন আবেগ,চিন্তা,প্রাপ্তি,অপ্রাপ্তি,সুখ,দুঃখ,না বলা কথা,না ছোঁয়া মন,অপেক্ষা সব টুকু বহন করে আনছে দিনের পর দিন।তুলো বেরিয়ে আসা,স্প্রিং ঝোলা একটা ধ্বজা সিট।ওদের অনুভুতি গুলো সিটের ধুলোয় মিশে গেছে।আমি ইচ্ছে করেই ডাস্টার দেই না সেখানে।হয়তো তাদের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াগুলো মুছে ফেলতে চাই না বলেই।মুছে ফেলতে আমি কোনদিনই চাইনি কিছু।তবু কেন সেদিন বৃষ্টির রাতে অকারণে তোমায় খুঁজে পেলাম,আর কেনই বা হারিয়ে ফেললাম...আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
অামার ট্যাক্সির ব্যাকসিটটাকে সেদিন প্রথম কাঁদতে দেখলাম আর পাশের সিটটাকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে।"এ ট্যাক্সি সিধা চালো,রুকনা মত",আমি সামনের আয়নায় গাড়ি আর স্ট্রিটলাইটের টিমটিমে আলোর তোমার মায়া ভরা মুখটা দেখলাম প্রথমবার।কিন্তু তোমার সাথে গাড়িতে যে মানুষটি উঠলো সে আমায় থামতে বারণ করলো কেন সেটা সময়ের সাথে বুঝতে পরলাম বেশ।একের পর এক ট্রাফিক সিগনাল,গলির মোড়,সড়কের পাশে ভিখিরির বাড়ি পার করে যত এগিয়েছে গাড়ির চাকা,ওই মানুষটি তোমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে জন্তুর মতো।আয়নার দিকে যতবার চেয়েছি আমার হাতের মুঠো ততবার শক্ত হয়েছে তোমার আড়ষ্ট শরীর আর কালসিটে পরা চোখ দেখে।আমি বুঝেছি,কোনো বিপদ তোমাকে ছেঁকে ধরেছে,তুমি তীব্র অনিচ্ছায় সে আক্রমণ গায়ে তুলে নিচ্ছ।জানলার ঝাপসা কাঁচে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আছড়ে পরে আমার অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক খানি বাড়িয়ে দিয়েছে।তোমার সাথে ওই আয়নাতে চোখে চোখ পরতেই তুমি জড়তা ভাঙ্গলে,গোপন করতে চাইছ সবটাই।একটা গোটা পৃথিবী ভাগ হয়ে গেছে সিটের এপার ওপারে।তোমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে রক্ত শুষতে শুষতে সে বলল,"য়ে শালা ট্যাক্সি ড্রাইভার দিখনে সে কুছ নেহি হোগা,এক্সট্রা পাইসা দে দেংগে"।তোমার বুকের বোতাম খুলে সিটে শুইয়ে সে যেন নিজের পাওনা বুঝে নিল গোটা রাস্তায়।তুমি আমার ছেড়া ফাটা ব্যাকসিট কতখানি খিমচে ধরেছিলে যন্ত্রণায় সেটা আমি শূন্য পাশের সিটটা আঁকড়ে বুঝতে পেরেছি।নরখাদকের খিদের শেষ মুখে এসে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে দিতে পারলে হয়তো তুমি বেঁচে যেতে আর আমিও মুক্তি পেতাম পাপ থেকে।তুমি তো অপরিচিতা,তাও সে রাতে আমি ক্ষত বিক্ষত হয়ে গাড়ি টেনে নিয়ে গেছি দ্রুত।সব কিছুর শেষে তুমি নেমে গেলে হাতে একটা সাদা খাম নিয়ে একটা অন্ধকার গলির কাছে,তোমার মিছি মিছি যৌনতার রেমুনারেশন।নামতে নামতে ঘুরে তাকালে আমার দিকে।যেন বলতে চেয়েছ,আমি এপথে হাটতে চাইনি, যা দেখলে ভুলে যেও।গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলে বৃষ্টির মধ্যে।জলে হেঁটে চলার শব্দ পেলাম,তারপরiই মুহূর্তে অন্ধকারেবিলীন।বাড়ি ফিরে বহু বছর পর পেছনের সিটটা মুছে রাখলাম...রুমালে যেন তোমার মৃত বুকের রক্ত উঠে এলো।
সেদিনের পর ওই রুটে অনেক খুঁজেছি তোমাকে,কিন্তু দেখতে পাইনি আর কখনও।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন