চোদ্দটা শাক তো খান প্রতিবার ভূত চতুর্দশী তে জানেন কেন খান? পুরাণ মতে চোদ্দশাক খেলে চোদ্দটা অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে শুভ শক্তির সূত্রপাত ঘটে দেহে। প্রতিটি শাকের একটি আলাদা গুণ এবং প্রতিটিই অসুরদলনে সিদ্ধ।
চোদ্দশাক গুলো হল-
১.পালং শাক
২.কলমি শাক
৩.লাউ শাক
৪.কুমড়ো শাক
৫.পাট শাক
৬.সরষে শাক
৭.নটে শাক
৮.ধনে শাক
৯.মেথি শাক
১০.সুষনি শাক
১১.মুলো শাক
১২.হিঞ্চে শাক
১৩.গিমে শাক
১৪. পুইঁশাক
ঠিক তেমনই চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো রীতি চোদ্দ অসুর কে আগুনে ধ্বংস করে শুভের সূচনা। কিংবা প্রতন্ত গ্রামে শুনতে পাবেন বুড়ির ঘর পোড়ানো। না কোনো সত্যি বয়স্কার ঘর নয়। এও অনেক টা দশেরার মতোন ঠিক রামচন্দ্র যেমন রাবণ কে বধ করেছিলেন ঠিক তেমনি কালি পূজার আগে দুষ্টের দমনে বুড়ির ঘর পোড়ানো হয় তারপর লক্ষীর প্রতিষ্ঠা।
তবে এসব বোধ হয় এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে না উঠতে পারায় সব প্রথাই লুপ্তপ্রায়। তাই নাকি এখন অনেকের বিশ্বাস দিন দিন ভূত বা অতৃপ্ত আত্মার প্রকোপ আরও দৃঢ় হয়ে উঠছে বিশেষত শহরতলী জুড়ে। দেখে নিই শহরের সেরা চোদ্দ গা ছমছমে ভূতের ডেরা।
১. রাইটার্স বিল্ডিং : শহর সব থেকে ব্যস্ত একটি জায়গা সব স্বাভাবিক তবে তা সন্ধ্যে নামার আগে অব্ধি সন্ধ্যে নামলে কর্মচারীদের কাজ করার প্রবণতা নিম্নগামী। শোনা গিয়েছে প্বার্শবর্তী বাড়ি যাদের তারাও শুনতে পায় কান্নার শব্দ রাত বিরেতে।
২. নিমতলা শ্মশান : রাত গেলে ভয়ংকর রূপ নেয় এই শ্মশান। শোনা গেছে লোকমুখে সংস্কার না করেই অনেকে চলে যায় প্রাণভয়ে।
৩. এবং ৪. সিমেট্রি গুলো। পার্কস্ট্রীট বা লোয়ার ক্যালকাটা সিমেট্রি দুই ই ভয়ানক গা ছমছমে রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাত কেন শুধু মধ্যাহ্ন জুড়ে।
৫. পুতুলবাড়ি: কলকাতার ভয়ানক জায়গার মধ্যে অন্যতম নাম করা এই পুতুলবাড়ি। শোনা গেছে অনেক ভয়ংকর কাণ্ড কারখানা। আস্তে আস্তে সব বসত উঠে গিয়েছে বাড়িটিও ভয়ানক দানবী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন ভয় দেখানোর জন্যই।
৬. হাওড়াব্রিজ নিম্নস্থ গঙ্গাঘাট: ব্রিজ সংলগ্ন ঘাটের নিচ এক ভয়ংকর স্থান হিসেবে শোনা গিয়েছে। এখানে আসলে আত্মহত্যা থেকে এক্সিডেন্ট সব দেখা যায় ঠিক এই জায়গায়।
ভোর ৪টের সময় কিছু সাহায্যপ্রাপ্য হাত উঠে আসে জল থেকে আর আপনি সেই ফাঁদে পা দিলে ব্যস....
৭. রয়াল ক্লাব: যেখানে ঘোর দৌড় হয় শোনা গিয়েছে সাদা ঘোড়া ছুটতে দেখা যায় শনিবার রাতে।
৮. পোস্তা ব্রিজ: সম্পতি ব্রিজ ভেঙে পড়ায় অসংখ্য প্রাণ আটকা পড়ে যায় ব্রিজের তলায় তাদেরই অতৃপ্ত অশরীরী আত্মা দেখা যায়। কখনো জল চাইতে বা কখন বাচানোর কাতর প্রার্থনায়।
৯. রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন: ভূতের আবির্ভাব সোজা ষ্টেশন বা রেল লাইনে এমন কি চালক দেখতে পেয়েছে বলে শোনা যায়।
১০. হেস্টিং হাউজ: এখান থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে, শোনা যায় বলে ধারণা। আত্মহত্যার জন্যই এরূপ শোনা যায় বলে দাবি অনেকের।
১১. মিউজিয়াম : মরা মানু্ষের কংকাল থেকে জন্ম ভূতসমূহের বলে ধারণা অনেকের।
১২. ন্যাশেনাল লাইব্রেরি : অনেকেই এখানে অশরীরী আত্মার হনন দেখতে পেয়েছে। আত্মহত্যার গুজব থেকে হত্যা সব ই শোনা গিয়েছে।
১৩. ক্যালকাটা হাই কোর্ট: শোনা যায় মৃত্যু দন্ডই প্রেতাত্মার উতপাতের কারণ।
১৪. কলকাতা বন্দর: কলকাতা বন্দর রাতে অন্যতম ভয়ানক রূপ নেয়। অনেকের প্রাণ নাকি এখনো বন্দি এই বন্দরে।
চোদ্দ ভূতূরে জায়গার চোদ্দ কাহনের পর আসা যাক বাঙালী ভূতের দলের কাছে। নাম করা থেকে বেনামী অনেক ভূত আছে তাদের কিছুই হল-
১. পেত্নী: পেত্নী হলো নারী ভূত যারা বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেত্নী শব্দ থেকে এসেছে (পুরুষবাচক শব্দ প্রেত)। এসব ভূত সাধারনত যে কোন আকৃতি ধারন করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এসব ভূত সাধারনত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারনত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রোমনের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো।
২.শাকচুন্নি: শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শাকচুরনীথেকে এসেছে। এটা হলো বিবাহিত মহিলাদের ভূত যারা বিশেষভাবে তৈরি বাঙ্গালি শুভ্র পোশাক পরিধান করে এবং হাতে শঙ্খ বা শাঁখা পরিধান করে। শাঁখা হলো বাঙ্গালি বিবাহিত মহিলাদের প্রতীক। শাকচুন্নিরা সাধারনত ধনী বিবাহিত মহিলাদের ভেতর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে করে তারা নিজেরা সেই মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকগাঁথা অনুসারে তার আমগাছে বসবাস করে।
৩.চোরাচুন্নি: চোরাচুন্নি অত্যন্ত দুষ্ট ভূত। এরা মানুষের অনিষ্ট করে থাকে। সাধারনত কোন চোর মৃত্যুবরণ করলে চোরাচুন্নিতে পরিনত হয়। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িতে গঙ্গাজলের (বাংলা সংস্কৃতিতে গঙ্গা জলকে পবিত্র জল হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ব্যবস্থা করা হয়।
৩.পেঁচাপেঁচি: এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূত ধারনাটি পেঁচা থেকে এসছে এর স্ত্রী বাচক হলো পেঁচি। এরা জোড়া ধরে শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এরা সাধারনত জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও এরা শিকারের দেহ ভ্যাম্পায়ার স্টাইলে ছিড়ে ছিড়ে খায়।
৪.মেছোভূত: এ ধরনের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো শব্দটি বাংলা মাছ থেকে এসেছে। মেছো ভূত সাধারনত গ্রামের কোন পুকুর পাড়ে বা লেকের ধারে যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায় সেখানে বসবাস করে। মাঝে মাঝে তারা রান্নাঘর বা জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাঁড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।দেও: এধরনের ভূত নদীতে বা লেকে বসবাস করে। এরা লোকজনকে পানিতে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়।
৫.নিশি: ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের গলায় নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ফিরে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিনত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনী অনুসারে নিশিরা কোন মানুষকে দুবারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই কারো উচিত কেউ তিনবার ডাকলে বের হওয়া তাতে নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।
৬.মামদো ভূত: হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমানআত্মা।
৭.গেছোভূত: গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে।
৮.ব্রহ্মদৈত্য: এধরনের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারনত কারো ক্ষতি করে না। এ ধরনের ভূতরা হলো ব্রাহ্মণের ভূত। সাধারনত এরা ধূতি ও পৈতা পরিহিত অবস্থায় বিচরণ করে। এদেরকে পবিত্র ভূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা অত্যন্ত দয়ালু ও মানুষকে অনেক উপকার করে থাকে। বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে এদের চরিত্র চিত্রায়িত হয়।
৯.আলেয়া: রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া দেখা যায়। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেয়া এর উৎপত্তি। এর ফলে জেলেরা ভুল বুঝে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
১০.বেঘোভূত: এরা হলো সেইসব মানুষের আত্মা যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সাধারনত সুন্দরবন এলাকায় এধরনের ভূতের কথা বেশি প্রচলিত কারণ বাঘের অভাশ্রম হলো সুন্দরবন। এসব ভুতেরা জঙ্গলে মধু আহোরনে আগত গ্রামবাসীদের ভয় দেখায় এবং বাঘের সন্নিকটে নিয়ে যেতে চেষ্ঠা করে। মাঝে মাঝে এরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য বাঘের স্বরে কেঁদে উঠে।
১১.স্কন্ধকাটা/কন্ধকাটা/ কবন্ধ: এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। সচরাচর এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে যেমন, রেল দূর্ঘটনা বা অন্য কোন দূর্ঘটনা। এ শ্রেণীর ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায় এবং অন্য মানুষকে আক্রমণ করে তাদের দাসে পরিণত করে ও তার মাথা খুঁজার কাজে নিয়োগ করে।
১২.কানাভুলো: এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘোরপাক খেতে থাকে। ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌচ্ছার পর তার শিকারকে মেরে ফেলে। এক্ষেত্রে শিকার তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এধরনের ভূতদের রাতে গ্রামের মাঠের ধারে পথের মধ্যে দেখা যায়। শিকার সবসময় একাকী থাকে বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
১৩.ডাইনী: ডাইনী মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। বাংলা লোকসাহিত্যে সাধারনত বৃদ্ধ মহিলা যারা কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যাতে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনীরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে।
১৪.ঝেঁয়ো পেত্নী: সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যাবেলায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরুতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এ জাতীয় পেত্নীরা।
১৫.ডাকিনী: ডাইনি বুড়িদের অনুগতশ্রেণির ভূত। পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে এরা। থাকে পুকুর বা দিঘীর ধারে কোনো তাল বা নারিকেল গাছে। রাতদুপুরে মেয়েলোকের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।
আর শেষমেশ সেই বিখ্যাত ভূত তাড়ানোর মন্ত্রে বিশ্বাস রাখুন আর চতুর্দশীতে এদের বিদায় দিন।
"ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি
রাম লক্ষণ বুকে আছে, করবে আমায় কি?"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন