অঘোরনাথ চক্রবর্তী। |
বসন্তের সেই সকালে সোনারপুর স্টেশনে বসে আপন মনে চোখ বন্ধ করে ভৈরবীতে গুনগুন করে গান ধরেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। ট্রেন আসতে তখনও খানিকটা সময় বাকি। তাই আপন মনে তিনি গেয়ে চলেছিলেন, ‘বিফল জনম বিফল জীবন, জীবনের জীবনে না হেরে...।’ দূরে হঠাৎই ট্রেনের শব্দে যখন ঘোর ভাঙল, তত ক্ষণে সেই ভদ্রলোকের আশেপাশে রীতিমতো ভিড় জমে গিয়েছিল। কিছুটা বিস্মিত অবস্থায় তিনি ট্রেন ধরতে উঠতে যাবেন, এমন সময় স্টেশনের শ্রোতারা বাধা দিয়ে বললেন, ‘গান বন্ধ করবেন না। এক দিন দেরি হলে না হয় হবে। এমন গান তো আর রোজ শোনা যায় না।’
অগত্যা গান চলতে লাগল। যখন গান শেষ হল তখনও প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত সেই কণ্ঠস্বরের আকর্ষণে বেশ কিছু যাত্রী-সহ ট্রেনের চালক, এমনকী স্টেশন মাস্টারও তত ক্ষণে সেখানে হাজির হয়েছেন গান শুনতে। যাঁকে ঘিরে এই ভিড়, তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বেশ অপ্রস্তুত! তবে যাত্রী এবং ট্রেনের চালকের আশ্বাসে তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েই গান শেষ করেছিলেন। এই ঘটনাটির উল্লেখ মেলে দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখায়।
সেই গায়কের কণ্ঠ মাধুর্যে সে কাল থেকে এ কালের শ্রোতারা মোহিত হয়ে রয়েছেন। তিনি বাংলা গানের এক বিস্মৃত পথীকৃৎ আঘোরনাথ চক্রবর্তী। দুঃখের বিষয়, তাঁর কণ্ঠস্বরের খুব সামান্যই ধরা আছে সে কালের অনুন্নত রেকর্ডিং পদ্ধতিতে। তবু সেগুলি শুনলে বোঝা যায় তাঁর কণ্ঠ মাহাত্ম্য। আর হয়তো সেই কারণেই তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাঁর গানের খোঁজ করেন সঙ্গীত রসিকেরা।
১৮৫৪-য় অঘোরবাবুর জন্ম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুরে। অল্প বয়স থেকেই কর্মসূত্রে তাঁকে কলকাতার বেলেঘাটায় যাতায়াত করতে হত। সেখানে নন্দীবাবুদের গোলায় তিনি চাল বেচাকেনার মধ্যস্থতার কাজ করতেন। আর সেই সঙ্গে চলত সঙ্গীতচর্চা। অঘোরবাবু সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন উস্তাদ আলিবক্সের কাছে। ধ্রুপদ শিখেছিলেন উস্তাদ মুরাদ আলি এবং দৌলত খাঁর কাছে। এ ছাড়াও প্রবাদপ্রতীম শ্রীজান বাঈয়ের কাছে টপ্পা শিখেছিলেন। ভোলানাথ দাসের কাছে ভজন এবং গীতও শিখেছিলেন তিনি। আঘোরবাবু আসর মাতাতেন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ভজন গেয়ে। সে কালের বেশির ভাগ ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পীরা আলাপের উপরে জোর দিতেন। কিন্তু, অঘোরবাবু ছিলেন এর ঠিক বিপরীত। তিনি কখনও আলাপের উপর জোর দিতেন না। বরং মনে করতেন আলাপ যেন সময় নষ্ট।
১৯০২ থেকে এ দেশে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ডের ব্যবসা শুরু করে। আর সেকালের রাজা-মহারাজারা তাঁদের সভার গায়ক-গায়িকাদের গান রেকর্ড করার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন। এ জন্যই সে কালের বিখ্যাত কিছু শিল্পীর গান রেকর্ডবন্দি করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু, অঘোরবাবু গান রেকর্ড করতে একে বারেই আগ্রহী ছিলেন না। তিনি পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের অন্যতম সভাগায়ক ছিলেন। এই নিয়ে এক মজার ঘটনা শোনা যায়। যতীন্দ্রমোহন জানতেন তাঁর এই আপত্তির কথা। তাই তাঁকে কিছু না জানিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে গান রেকর্ড করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে স্টুডিওয় নয়, তাঁরই প্রাসাদে। সেখানেই পর্দার আড়ালে যন্ত্রপাতি সাজানো ছিল। অঘোরবাবু গান শুরু করা মাত্রই শুরু হয়েছিল রেকর্ডিং। গানগুলি কেবল মাত্র তানপুরা বাজিয়ে গাওয়া হয়েছিল। রেকর্ডগুলির উপর শিল্পীর নামের পাশাপাশি লেখা থাকত ‘ফর্ম দ্য হাউসহোল্ড অব হিস হাইনেস মহারাজা যতীন্দ্রমোহন টেগোর’। এ ভাবে পাঁচটি গান রেকর্ড করা হয়েছিল— ‘আনন্দবন গিরিজা (ভজন)’, ‘বিফল জনম বিফল জীবন (ভৈরবী)’, ‘নজর দিলবাহার (টপ্পা)’, ‘গোবিন্দ মুখারবিন্দে (ভজন)’ এবং ‘লপ লপটানে (ধামার)’। পুরনো গানের সংগ্রাহকদের কাছে এই সব গানের রেকর্ডগুলি দুর্মূল্য কালেক্টর্স আইটেম।
মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও কতটা প্রসঙ্গিক তাঁর গান?
সিডিতে প্রকাশিত শতবর্ষের রাগাশ্রিত গানের সঙ্কলন হোক বা পুরনো দিনের বাংলা গানের অ্যালবাম, সেখানে আজও মাঝে মধ্যেই জায়গা পায় অঘোরবাবুর শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বরের কিছু নমুনা। শিয়ালদহের চোরা বাজার বা ওয়েলিংটনের পুরনো রেকর্ডের দোকানে আজও তাঁর রেকর্ডের সন্ধানে ফেরেন সংগ্রাহকরা।
শোনা যায় আসরে গান গাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। আসরে মন মতো পরিবেশ না পেলে তিনি গান না-গেয়েও উঠে আসতেন।
এক আসরে সে কালের অন্য এক প্রখ্যাত শিল্পী লালচাঁদ বড়াল তাঁর গানের সঙ্গে পাখোয়াজে সঙ্গত করতে চেয়েছিলেন। সে সময় অবশ্য লালচাঁদ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা বা প্রতিষ্ঠা পাননি। কিন্তু, অঘোরবাবু তাতে সম্মত হননি। ‘‘আর এক দিন হবে।’’ এমনটা বলে বেশ কয়েক বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এতে লালচাঁদ ভীষণ অপমানিত বোধ করায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর কখনও পাখোয়াজ ছোঁবেন না। পরে অবশ্য সঙ্গীতের তালিম সম্পূর্ণ করে তিনি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আর এক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় রয়েছে, কাশীতে অঘোরবাবুর একটি অনুষ্ঠানের কথা। সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন সে যুগের তাবড় তাবড় অবাঙালি সঙ্গীত শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে এক মাত্র অঘোরবাবুই ছিলেন বাঙালি। আর ছিলেন কিছু বাঙালি শ্রোতা। হঠাৎই শোনা গেল অবাঙালি শিল্পীরা বাঙালিদের গান নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছেন। তাঁদের ধারণা, কালোয়াতি গান গাওয়া বাঙালিদের কাজ নয়! অঘোরবাবু চুপচাপ শুনে গেলেন। যথা সময়ে শুরু হল আসর। দু’এক জন শিল্পীর গানের পরে অঘোরবাবুর গান শুরু হল। বেশির ভাগ অবাঙালি শ্রোতা আছেন জেনেও তিনি ধরলেন একটি বাংলা গান। ‘বিফল জনম, বিফল জীবন’। সচরাচর তিনি আসরে ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল গাইতেন। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে তিনি তা করলেন না। প্রাণপণ দরদ দিয়ে টপ্পার আঙ্গিকে গানটি গাইলেন। যদিও তিনি জানতেন অবাঙালি শ্রোতারা গানের কথার অর্থ বুঝবেন না। গান যখন শেষ হল, তখন কারও মুখে আর কোনও কথা নেই। সকলেই সেই সুরের মূর্চ্ছনায় যেন আপ্লুত, মোহিত। এই ছিলেন অঘোরবাবু, যিনি তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই সেই আসরে নীরব প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বাঙালির মানও রেখেছিলেন।
জীবনের শেষ ১০ বছর অঘোরবাবু কাশীতে কাটিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমরনাথ ভট্টাচার্য, নিকুঞ্জবিহারী দত্ত, পুলিনবিহারী মিত্র উল্লেখযোগ্য। ১৯১৫ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন