-পার্থ ঘোষ –
ষোল পাতার চিঠিটা
লিখেছিল ছাব্বিশ বছরের মৃত্তিকা। মৃত্তিকা
অর্থাৎ মৃত্তিকা দাস। দাস পদবীটা মাস চারেক হল অর্জন করেছিল সে। বাবার পদবী
পাল। অতএব সে ছিল মৃত্তিকা পাল। বিবাহ সূত্রেই বদল হয়েছিল পদবী। বিবাহ হয়েছিল
সরকারি চাকুরে অসিতের সঙ্গে ।
অসিত চাষী-বাসী
গেরস্থ। ধান জমি, পানের বরজ, আখ ক্ষেত এসব নিয়ে গ্রামের অবস্থাপন্ন লোক। বাস রাস্থা থেকে ভ্যান রিক্সায় পঁচিশ মিনিট
দূরত্বে পৈত্রিক পাকা দোতলা বাড়ী।
অসিতরা তিন ভাই দুই
বোন। দুই বোনেরই বিয়ে হয়েছে গ্রামেরই
অবস্থাপন্ন দুই ঘরে। অসিত সবার ছোটো। দুই দাদার বিয়ে অনেকদিন আগেই হয়েছে। বাকী ছিল ছোটো ভাই অসিত। মাস চারেক আগে তারও
বিয়ে হয়ে গেছে পাশের গ্রামের মৃত্তিকার সঙ্গে, বেশ ধূমধাম করেই।
অসিতের চাকরির বয়স
পাঁচ বছর। কলকাতায় অফিস। প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। বাড়ী থেকে প্রথমে ভ্যান রিক্সায় বাস স্ট্যাণ্ড,
তারপর বাসে চড়ে রেল ষ্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে করে কোলকাতায় পৌঁছে আবার বাস ধরে
অফিস পৌঁছতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তাই অসিতকে সকাল সকাল-ই বেরিয়ে পড়তে হয়। রাতে বাড়ী ফিরতেও বেশ দেরী হয়ে যায়। তার ওপর ট্রেনের গণ্ডোগোল থাকলে তো কথাই নেই,
সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা কত ঘণ্টায় শেষ হয় তার হিসাব রাখা দায় হয়ে পড়ে। অবশ্য পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে
ব্যাপারটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই
অসুবিধাটা বুঝতে পারে না সে।
অনেক দেখাশুনা
খোঁজখবর নেবার পর ছাব্বিশ আর ছত্রিশের মৃত্তিকা ও অসিতের জুটি বেশ নয়ন মনোহরই
হয়েছিল। দুটিকে মানিয়ে ছিলও ভালো। নতুন সংসারে বেশ গুছিয়েও নিয়েছিল মৃত্তিকা। শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি, ভাসুর, ভাজদের ক্রমশঃ
প্রিয় পাত্রীও হয়ে উঠেছিল। কাজকর্ম দেখে
বুঝে নিচ্ছিল। রান্না ঘরের দায়িত্বও আস্থে
আস্থে পালন করছিল মনোযোগ সহকারে। স্বামীর
দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজ হাতে । অসিতের যত্নের কোনরকম ত্রুটি হতে দিত না। মোটকথা
মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই স্বামীর ঘরকে সে নিজের বাবার ঘরের চেয়েও বেশী আপন করে
নিয়েছিল। কুড়িয়ে নিয়েছিল সবার স্নেহ, ভালোবাসা আর আশীর্ব্বাদ।
সারাদিন কাজ করার পর
দিনের শেষে সে শুধু একটা খাতা ও কলম নিয়ে লিখতে বসত নিভৃতে। এই ব্যাপারটা যে অসিতের চোখে পড়েনি তা নয়। কিন্তু দু’একবার জিজ্ঞেস করার পরও যখন
মৃত্তিকার কাছ থেকে একই উত্তর পেত – লেখা শেষ হলে দেখাব। তখন অসিত আর সেই নিয়ে
কোনো প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছিল। মনে করেছিল, লেখা শেষ হলে যখন দেখাবে বলেছে,
তখন তাই হবে।
মৃত্তিকা গ্রামের
বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করা মেয়ে। বিয়ের সময়ে অসিত শুনেছিল তার গল্পের বই পড়ার
নেশা আছে। অসিত চিন্তা করেছিল মৃত্তিকার হয়ত গল্প, কবিতা বা দিনলিপি লেখার অভ্যাস
আছে, তাই হয়ত সে ফাঁকা পেলেই সেসব নিয়েই বসে পড়ে।
অসিতের আবার গল্প কবিতা পড়ার ঝোঁক কম। তাই সে বউয়ের এই খামখেয়ালিপনাকে খুব
একটা গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন মনে করেনি।
তাকে তার মতনই থাকতে দিয়েছে। বারংবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করতেও চায়নি।
মৃত্তিকাও লেখা নিয়ে
অসিতের সঙ্গে কোনরকম আলোচনায় যেতে চায়নি।
সে তার নিজের জগতে হারিয়ে যেত একাকী নিভৃতে সারাদিনের ব্যস্ত সময় থেকে চুরি
করা সামান্য সময়টুকুকে পাথেয় করে।
নতুন দুটি জুটির
সাংসারিক বোঝাপড়ার মধ্যে একটা সহৃদয়তা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসার বন্ধন ক্রমশঃ অটুট হয়ে
উঠেছিল দুটি অপরিচিত মানুষের কাছে। দুজনে জড়িয়ে গেছে দৈনন্দিন অভ্যাসের বেড়াজালে।
নতুন বউ হয়েও
সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল মৃত্তিকা সস্নেহে দায়িত্ব
সহকারে। তার অপটু হাতে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন হত অতীব যত্নের সঙ্গে। মৃত্তিকা বাড়ীর সকলের মন জয় করে নিয়েছিল খুব
অল্প সময়ে।
আজকের সকালটাও
প্রতিদিনের মতই শুরু হয়েছিল। দুপুরটাও
কেটে গিয়েছিল অন্য দিনের মতই। দপ্তরের কাজ
শেষে অসিত বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছিল বিকেলে।
কিন্তু ট্রেন থেকে ষ্টেশনে নামতেই বড়দা যতীশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল;
সঙ্গে যতীশের বন্ধু গ্রামেরই পঞ্চায়েত
সদস্য প্রীতমদা। অসিত একটু অবাকই হয়ে
গেল। হঠাৎই মনে হ’ল বাড়ীতে কারো কিছু হল
না তো! কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে চলে গেল এই ভেবে যে সেরকম কিছু হলে তো তাকে মোবাইলে ফোন করেই খবর দেওয়া
হত। সন্দেহটা মন থেকে মুছে গেল। তবু দাদাকে জিজ্ঞেস করল ষ্টেশনে আসার কারণটা কি!
প্রীতমদা বলল – এদিকে এসেছিলাম দেখলাম তুই ট্রেন থেকে নামছিস তাই দাঁড়িয়ে
গেলাম। চল একসাথেই বাড়ী ফেরা যাক। অসিত প্রীতমদার কথাটাই মেনে নিল। সাধারণ ব্যাপার, মনে কোনো আঁচড় কাটার কথাও নয়।
কিন্তু অসিত
ব্যাপারটাকে যতটা সাধারণ মনে করেছিল ঘটনাটা ততটা সহজ ছিল না। বাড়ীর কাছে সে অগুণতি মানুষের ভীড় দেখে অবাক হয়ে
গেল। মানুষগুলোর থমথমে মুখগুলোর দিকে চেয়ে
মনটা কূ গেয়ে উঠল। অসিত দেখল তার
উপস্থিতিতে সবার করুণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তার দিকেই নিক্ষিপ্ত হল। গণনার অযোগ্য বহু চোখের দৃষ্টি তীরের মত বিদ্ধ
করল অসিতের শরীরটাকে। অসিতের হৃদস্পন্দনের গতি বর্ধিত হল।
অসিত দাদার দিকে
তাকাল। দাদার চোখে শোকের ছায়া দেখল। যতীশ তার ডান হাতটা ভাইয়ের কাঁধে স্থাপন করল
সস্নেহে। যতীশের হাতের ভারে কাঁধে ভরসার
ভার অনুভব করল অসিত। শুনতে পেল দাদার চাপা
স্বর – ‘বাড়ীর ভেতর চল, বলছি।’
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন,
বন্ধুবান্ধবদের ভীড় দু’দিকে সড়ে গিয়ে অসিতদের রাস্তা করে দিল বাড়ীতে ঢোকার
জন্য। দৃষ্টির তীরে ক্ষতবিক্ষত অসিত ঘরে
ঢুকে দাদার দিকে তাকাল নির্বাক জিজ্ঞাসায়।
যতীশ অসিতের দুই
কাঁধে দুই হাত স্থাপন করে মৃদু স্বরে ধরা গলায় বলল – ‘বৌমা আত্মহত্মা করেছে।’ অসিতের মাথাটা ঘুরা গেল হঠাৎই। ধরিত্রী যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল চরাচর। শুধু কানে ভেসে এল দাদার কণ্ঠস্বর – ‘তোর ঘরেই
গলায় দড়ি দিয়ে........’ কথা শেষ করতে পারল না যতীশ, কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
চোখের জল বাঁধ ভাঙতে চাইল। অতি কষ্টে অশ্রু সংবরণ করল সে।
অসিত একটু ধাতস্থ
হতে সময় নিল। কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হতে, অপ্রত্যাশিত সত্যর মুখোমুখি দাঁড়াতে
কিছু সেকেণ্ড, মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেল যার হিসেব করা গেল না। বাড়ীর লোকের চাপা
ক্রন্দন ধ্বনির মধ্যে দিয়ে যতীশ, প্রীতম আর স্থানীয় থানার বড়বাবু সঙ্গে নিজের ঘরের
দিকে গেল অসিত।
আবার একটা ধাক্কা
অসিতের ওপর আছড়ে পড়ল। কড়িবরগা ধেকে কাপড়ের
ফাঁস বাঁধা মৃত্তিকার ঝুলন্ত শরীরটা এক
পলক দেখেই অসিত দাদার বুকে মুখ লুকোলো ।
কান্নার দমকে শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তার। এতক্ষণ পর যতীশ ভেঙ্গে
পড়ল। তার চোখের উষ্ণ প্রস্রবণ ভাইয়ের
মাথায় ঝরে পড়তে লাগল। থানার বড়বাবুর গম্ভীর কণ্ঠ ঘোষণা করল – ‘এবার কাজ শুরু করতে
হবে।’
মৃত্তিকার নিষ্প্রাণ
শরীরটাকে মেঝেতে শোয়ানোর পর পুলিসি কায়দায় সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে আবিষ্কৃত
হল ষোলো পাতার সেই চিঠি যাতে মৃত্তিকা লিখে গেছে এক অপ্রকাশিত জীবন কাহিনী। বড়বাবু সেই কাহিনী পাটোদ্ধার করে সংক্ষেপে
বাড়ীর লোকের কাছে প্রকাশ করলেন।
মৃত্তিকার কাহিনী
উন্মোচিত হল; যাতে তার শ্বশুড় বাড়ীর কারো প্রতি কোন ক্ষোভ, রাগ বিদ্বেষের ছায়াও
পাওয়া গেল না, শুধু জানা গেল গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে ভালোবাসা আছে জেনেও
বাবা-মায়ের জেদের ফলে অসিতকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া মৃত্তিকার জীবনের এক করুণ
কাহিনী। গ্রামের সরল মেয়ের পক্ষে পুরান
প্রেমিকের ভালোবাসাকে উপেক্ষা ক্ষমতা অর্জন করতে না পারার এক হৃদয় বিদারক
গল্প। নতুন স্বামী, শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী এবং
বাড়ীর প্রত্যেকটি লোকের ভালোবাসায় ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা মৃত্তিকার মনের অপরাধ
বোধ যা তার স্বামীর কাছে আসল সত্যি প্রকাশ করতে না পারার জন্য বিন্দু বিন্দু করে
সঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, মনে হয়েছিল শ্বশুড় বাড়ীকে সে প্রতারণা করছে, স্বামী অসিতের
সঙ্গে সে মিথ্যাচার করছে; এমত মানসিক অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না পেরে সমস্থ
কাহিনী ষোলো পাতায় প্রকাশ করে সবাইকে বঞ্চনার হাত থেকে উদ্ধার করে নিজেকে সরিয়ে
নিল নিঃশব্দে, বাড়ীর সকলের কোন এক অসতর্ক মু্হুর্তে।
শুধু দুটো বড় কাঁটা বিদ্ধ
করে দিয়ে গেল বাবা-মা-র স্নেহভরা বুকে। হতভাগিনী মৃত্তিকা বুঝলো না জেদাজেদী নয়,
মেয়ের ভবিষ্যতে ভালো হবে চিন্তা করতে গিয়েই মেয়েকে হারাল তার বাবা-মা। বেকার ছেলের
সঙ্গে ভালোবাসা আছে জেনেও তাঁরা সরকারী চাকুরে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন
মৃত্তিকার, এই ভেবে যে সংসারের চাপে, বয়সের অভিজ্ঞতায় স্বামীর ভালোবাসায়,
স্বচ্ছলতায়, তাদের মেয়ে একদিন ভুলে যাবে তার ছোটোবেলার ভালোবাসার মানুষকে। বুঝতে পারবে তার জীবনের ভালোটাকে। বাবা-মা-র অশীর্ব্বাদকে । কিন্তু কারো নিয়তিতো কেউ খণ্ডাতে পারে না।
নিয়তি তার আপন পথে আসে সব কিছুকে নিমিত্ত মাত্র ঘোষণা করে। মৃত্তিকাও সেই নিয়তির
বিধানেই বিদ্ধ।
মৃত্তিকার জীবনের
করুণ কাহিনী নাড়া দিয়ে গেল থানার ডাকসাইটে বড়বাবুকেও। মানুষ হিসাবে তার চোখের পাতাও ভারী হয়েই আসছিল,
কিন্তু দায়িত্ব কর্ত্তব্য আর উর্দির সম্মান রক্ষার্থে তিনি নিজেকে শক্ত করে
মৃতদেহের আইনানুগ ব্যবস্থা করে বাড়ীর সবাইকে থানায় দেখা করতে বলে মৃত্তিকার ষোলো
পাতার মর্মান্তিক জীবন কাহিনীটি হাতে নিয়ে
পুলিশের জীপে উঠে থানার দিকে রওনা হলেন।
অসিতের বাড়ীর আনন্দ,
উচ্ছ্বাস, মৃত্তিকার মৃত্যুতে ধরিত্রির মৃত্তিকায় বিলীন হয়ে গেল।
___________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন