রূপ রস গন্ধ
পার্থ ঘোষ
পাখি পাখি পুষতে ভালোবাসে না। তার মনে হয় পাখি স্বাধীন
প্রাণী। তার স্বাধীনতাকে খর্ব করা উচিৎ
নয়। বদ্ধ হরে ধাকার কি কষ্ট, কি জ্বালা,
মনের কি যে ছটফটানি পাখি তা ভালো করেই নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে। মাঝে মাঝে শিকল কেটে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু সাহস হয় না। খাঁচার পাখির মত তারও
যে ডানা ভাড়ী হয়ে গেছে। বিশাল পৃথিবীতে
সেই ভাড়ী ডানা মেলে ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। তাই শুধু ডানা ঝাপটানই সার হয়, ওড়া
আর হয় না।
পাখি ভালোবাসার কাঙাল। ছেলেদের দেখলেই তার
ভালো লেগে যায়। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছেলেরা তাকে পছন্দ
করে না। পছন্দ না করার কারণ যদিও পাখি খুঁজে পায় না। তার জন্য সে বারবার নিজেকে
আয়নার সামনে দাঁড় করায়। একাগ্র হয়ে লক্ষ করে শরীরের খুঁত গুলোকে।
সে যে দেখতে সুন্দর নয় তা নয়। মুখশ্রীতে লালিত্য আছে, লম্বা কালো চুল আছে।
হাসিতে মিষ্টতা আছে। শুধু যা নেই, তা হল
তার শরীরের ভঙ্গিলতা। যা না থাকলে নারী
নারীত্ব লাভ করে না। পুরুষের চোখে মোহময়ী হয়ে ধরা দেয় না।
পাখি খুব রোগা। কোন বসনই তার গায়ে ঠিক ঠাক
ভাবে সজ্জিত হয় না। একে রোগা তাতে লম্বা । গালের হনু, কণ্ঠার হাড় হারমোনিয়ামের
রিডের মত উঠে থাকে। কিশোরী শরীরের সমতল বুকের মাংস পেশী এতই স্বল্প যে বসন ভেদ করে চোখে পড়ার মত নয় তো বটেই। শরীরের যেসব স্থান বয়ঃসন্ধির ছেলে ছোকরাকে
আকৃষ্ট করে পাখির সেসব কিছুই নেই। তাই
আয়নার সামনে বসন মুক্ত হয়ে সে শরীরের সেসব জায়গায় কোমল করে হাত বোলায় আর মনে মনে
বলে – তোমরা জাগো ! তবেই না আমি বাঁচব। না
হলে যে এই নারী জন্ম বৃথাই মনে হয়।
পাখির বন্ধু প্রকৃতি বেশ হৃষ্টপুষ্ট ।
গোলগাল শরীর, নিটোল গাল, ফুলোফুলো। হাত-পা গুলো পুরুষ্টু । ভরাট নিতম্ব। নিটোল পয়োধর।
ছেলেরা ওর প্রেমে পড়ে কিন্তু প্রকৃতি আবার ছেলেদের অতটা পাত্তা দেয় না। প্রেমে ওর
অ্যালার্জ্জী।
প্রকৃতি পাখিকে বলে – আমার কাছে হ্যাংলার মত
যে গুলো আসে, তাদের যদি তোর কাছে ভিড়িয়ে দিতে পারতাম, তবে হয়ত তোর সমস্যার সমাধান
হত।
পাখিও মনে মনে ভাবে সত্যিই যদি তাই হত।
কিন্তু বাস্তবে তা তো হওয়া সম্ভব নয়, তাই হয়ও না। সেই কারণেই পাখিকে কেউ প্রেম নিবেদন ও করে না।
পাখির তাই মাঝে মাঝে এই পরিবেশ থেকে,
প্রকৃতির কাছ থেকে পালিয়ে যেতে মন করে।
চারদিকের এই দমবন্ধ পরিবেশে সে হাঁফিয়ে
ওঠে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ্ও তখন
তাকে আনন্দ দিতে পারে না। সেসব সোশ্যাল মিডিয়ায়
তার অনেক বন্ধু। কিন্তু তারা সব বন্ধুই হয়ে আছে, তার বেশী নয়। চ্যাট করে, শেয়ার
করে, ভালোভালো শায়েরী পাঠায়, ছবি পাঠায়। কখনও কখনও আদিরসাত্মক কমেণ্টস্ করে, তবুও
কিন্তু পাখির সঙ্গে প্রেম করে না। দূর থেকেই যা করুক না কেন কাছে এলে তারা সবাই
খেজুর গাছ দেখার মতই আঁতকে ওঠে। খেজুর গাছ কে যেমন দূর থেকে সমান লাগলেও কাছে এলেই
তার মাহাত্ম বোঝা যায়। পাখির বেলায়ও
ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই হয়। তাই কেউ আর
কাছে আসে না, পাশে বসে না, পাখির হাত ও ধরে না।
তবে দিন তো সব সময় একই রকম যায় না, তাই এ
হেন পাখির জীবনেও একদিন প্রেম আসে। প্রেম আসে অনেকটা গুটি গুটি পায়ে, যদিও বেশ
আচমকাই। তার রূপের প্রশংসা করে। এবং এও
বলে যে সে পাখিকে ছাড়া বাঁচবে না। তার জীবনে পাখির প্রবেশের দরকার অবশ্যই আছে।
পাখি কি করবে ভেবে পায়না এহেন নিবেদনে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ছাতি ফাটা গরমে তৃষ্ণার্ত
পথিকের কাছে এক ফোঁটা জলের যেমন দাম, পাখির কাছে প্রেমের প্রেম নিবেদনের দাম তার থেকে কিছু কম নয়। তাই পাখি হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলতে পার না, সে
প্রেমের প্রেমকে সাদরে গ্রহণ করে। পাখির
সঙ্গে প্রেমের প্রেম হয়ে যায়।
প্রেমের বাতাস গায়ে লাগতেই পাখি সজীব হয়ে
ওঠে। তার জৌলুস হঠাৎই বাড়তে শুরু
করে। সে প্রগলভ্ হয়ে ওঠে। একটু যেন মনের মধ্যে অহংকারও বাসা বাঁধে। নিজেকে এবার তার নারী বলে মনে হয়। আয়নার সামনে নিরাভরণ দাঁড়ালে কেমন লজ্জা
বোধ করে। আর বসন পড়ে থাকলে নিজেকে সাজাতে
ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সে বোঝে প্রেম তার নারীত্বকে
হরণ করে ফেলেছে। সে শালোয়ারের ওড়না বারবার বুকের ওপর টেনে নামাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
পাখির শরীরে যৌবনের ঢল নামে।
ব্যাপারটা সাধারন। সচরাচর এরকম ঘটেই থাকে।
কার চোখে কখন কাকে ভালো লাগে, কার সঙ্গে কখন কার প্রেম হয়ে যায় তা নিজেরও অজানা
থেকে যায়। প্রেমের ও হয়ত হঠাৎই পাখিকে
ভালো লেগে যায় । ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা তৈরী হয়। ফলে পাখির প্রেমে পড়ে প্রেম।
আসলে ব্যাপারটা এতটা সোজা নয়। বিচিত্র এই জগতে কতই রহস্য আছে লুকায়ে। এক্ষণে তাই একটা চিন্তা থেকেই যায় প্রেমের প্রেমের
সত্যাসত্য কতটা! পাখি প্রেম পাগলিনী, প্রেম জ্বরে আক্রান্তা। বয়সের ধর্মের কাছে
পরাজিতা, তাই তার মনে সন্দেহ বাসা বাঁধে না। জীবনের প্রথম পুরুষকে সে আঁকড়ে
ধরে। এক অন্যরকম প্রেমকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে মালা গেঁথে ভালোবাসার রঙীন মুহূর্তগুলোকে
চয়ন করে একত্রিত করে।
প্রেমের পাখির সঙ্গে প্রেম হবার কারণটা
অদ্ভুত বটেই তবে অবাস্তব নয়। প্রেম
প্রকৃতিকে প্রেম নিবেদন করে প্রথমে।
প্রকৃতি প্রেমের প্রেমকে স্বীকৃতি দেয়। বেশ কিছুদিন প্রেমের জোয়ারে ভেসে
এঘাট ওঘাট ছুঁয়ে ওদের প্রেম যখন বর্ষার ভরা নদীর আকার ধারণ কর, ঠিক তখনই প্রকৃতি
প্রেমকে ছেড়ে বসন্তর জীবনে ঝুলে পড়ে।
ততদিনে বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে প্রেমের অনেক অর্থ, অনেক সময় নদীর জলের মত
ব্যয় হয়ে গেছে প্রকৃতির প্রেমের জোয়ারে। যদিও ব্যবসায়ীর ছেলে প্রেমের তাতে কিছু
এসে যায় না। এসে যায় যেখানটায়, সেখানটা হল
হেরে যাওয়ার অপমান। অপমানিত প্রেম
প্রেমটাকে বাবার ব্যবসার মত মনে করে। যেমন
তার সফল ব্যবসায়ী পিতা তার ব্যবসায় লোকসান দেখতে পান না, প্রেমও তেমনি তার প্রেমের
মধ্যে সবসময় লাভটাই দেখতে চায়, লোকসান নয়।
কিন্তু ব্যবসায়ীর একটা ব্যবসায় যখন লোকসান হয়েই গেছে তখন সে অন্য ব্যবসায়
মনোনিবেশ করতে চায়। আর সেই মনোনিবেশ করতে
গিয়ে প্রেম পাখির প্রেমে পড়ে। এতে এক তীরে দুটি পাখি মারার কথা চিন্তা করে সে
– প্রথমতঃ মেয়েদের ওপর একটা আক্রোশ মেটান; দ্বিতীয়তঃ
প্রকৃতিকে দেখান, বাজার দর তার কতটা ঊর্দ্বমূখী। যেহেতু প্রকৃতিই পাখির খুব কাছের
বন্ধু, সেইহেতু প্রেমের এই অদ্ভুত কিন্তু বাস্তব প্রেমময় কার্যকলাপের মাধ্যম
হিসেবে সে বেছে নেয় একমাত্র পাখিকেই। প্রেম এও জানে পাখি কতটাই প্রেমের জন্য কাতর,
পুরুষের স্পর্শের জন্য তৃষ্ণার্ত, তাই তার মাধ্যম নির্বাচনটা বেশ সঠিক হয় বলেই মনে
হয় তার।
এদিকে প্রকৃতি প্রেমের এই বদমাইশি সহজেই ধরে
ফেলে। পাখির চেয়ে প্রকৃতি অনেকটাই চতুর এবং পুরুষ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সম্পন্না। তার জীবনে পুরুষ প্রায়ই
আসে। পাখির আভিজ্ঞতার ঝুলির মত শূন্য নয় প্রকৃতির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। তাই পাখি প্রেমের চালাকি বুঝতে পেরে পাখিকে
সাবধান করতে গিয়ে একটা গণ্ডোগোল বাঁধিয়ে ফেলে। পাখি প্রেমের প্রেমে পাগল, তাই মেকি
ভালোবাসার রসে হাবুডুবু খেতে খেতে সে প্রকৃতির সতর্কবাণী হজম করতে পারে না। ভাবে প্রকৃতি প্রেমকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে, কিংবা
প্রেমের সঙ্গে পাখির প্রেম সে সহ্য করতে পারছে না। ফলে যা হবার তাই ঘটে – পাখি ও প্রকৃতির
বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল ধরে যায়। যেটা
প্রেমের পক্ষে আনেকটাই সুবিধার হয়।
প্রকৃতি আর বসন্তর প্রেম গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; প্রেম মাখোমাখো হয়।
পাখির সঙ্গে প্রকৃতির মুখ দেখা দেখি বন্ধ, বন্ধুত্বের ইতি। ফেসবুক পেজে
দুজনে বন্ধুত্ব হারায়, হোয়াটসঅ্যাপ্ থেকে মুছে যায় দুজনের কথোপকথোনের রেশ। প্রেম
চুটিয়ে প্রেমের অভিনয় করে চলে । পাখির শরীর নিয়ে, মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
সব কিছুরই খারাপ, ভালো দুটি দিক হয়। পাখির
শরীরে মাংস লাগে, পাখি তার শরীরের কৃশতা হারায়। ছেলেরা ওর দিকে এখন ঘুরে ঘুরে তাকায়;
পাখি তা দেখেও দেখে না, ঘ্যাম দেখায়।
ভাবটা এমন – এতদিন তাকাওনি এখন আমি তোমাদের পাত্তাই দেব না। পাখির পদক্ষেপে
এখন রাজহংসীর তাল, গ্রীবার আন্দোলনে কবুতরের চমক।
ক্রমশঃ পাখির কাছ থেকে চাহিদার অতিরিক্ত
কিছু পাওয়া হয়ে যাওয়ায় প্রেমের মনে পাখির প্রতি একটা অনীহা তৈরী হতে থাকে। প্রেম
মনে মনে পাখিকে ছেড়ে অন্য দাঁড়ে বসার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। পাখি তার কাছে
একঘেয়ে হয়ে যেতে থাকে যত দিন যায়।
প্রেম নানান রকম অছিলায় পাখির সাথে মেলামেশা
কমিয়ে দিতে থাকে। পাখির মনে এবার সন্দেহ বাসা বাঁধতে শুরু করে। এখন পাখির বয়স বেড়েছে
কিছুটা। তাছাড়াও পুরুষের সান্নিধ্যে এসে পুরুষের মনের ভাষা, চোখের ভাষা,
শরীরের ভাষা শেখার ক্ষমতা সে অর্জন করেছে। তার ফলে পাখির কেমন মনে হতে থাকে প্রেম
তাকে আর চায় না। কিন্তু, পাখির যে সব
গেছে। বন্ধু গেছে, মন গেছে, নারীত্ব গেছে, সতীত্ব গেছে। পাখি ভাবে সে এখন কি করবে?
তাই সে একদিন সরাসরি প্রেমকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। প্রেম সরাসরি তাকে ‘না’ বলে না যদিও, তবে
অজুহাত দেখায় ব্যবসার, বয়সের; বাবা-মার ইচ্ছার কথাও বলে। এমনকি এও বলে যে সে তার
বাবার সামনে গিয়ে বিয়ের কথা বলার ক্ষমতা রাখে না।
পাখি তার কথার উত্তরে তাকে মনে করিয়ে দেয় যে
প্রেম করার সময় সে বাবা, মায়ের পরামর্শ নিয়ে আসেনি। সে জিজ্ঞাসা করে কেন প্রেম তার
জীবনটা নষ্ট করে দিল। প্রেম উত্তর করে না,
শুধু চেষ্টা করছি, দেখছি কি করা যায় – এই বলে পাখিকে আস্বস্থ করার প্রচেষ্টা
চালাতে থাকে। এবং ক্রমশই সে পাখির কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ফোন নম্বর পাল্টায়। ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট
খোলে অন্য নামে। হোয়াটসঅ্যাপ থেকেও হারিয়ে যায়, যাতে পাখি তার সঙ্গে আর যোগাযোগ
করতে না পারে।
পাখি লজ্জা, ঘেন্না অবসাদে জর্জ্জরিত হয়ে
পড়ে। ইচ্ছে করে তার প্রেমের বাড়ী গিয়ে সব
কথা বলে প্রেমের বাবাকে। কিন্তু, পরক্ষণেই
মনে হয় ওরা বড়লোক। সামান্য একজন স্কুল শিক্ষকের মেয়ের এ হেন বাতুলতা ওরা মেনে তো
নেবেই না, উল্টে পাখির নাম কলঙ্কিত করবে, সমাজের সামনে সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়ে। আকাশ পাতাল ভেবে কূল করতে পারে না সে, এখন তার
কি করণীয় ?
শেষ পর্যন্ত সে
ঠিক করে মৃত্যুর পথই তার একমাত্র পথ। এ জীবন বাঁচিয়ে রাখার আর কোনো মানে খুঁজে পায়
না সে। তাই মনস্থির করে রাতের অন্ধকারে সে
বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে শহরের পশ্চিমের নদীর উদ্দেশ্যে।
নদীতীরে গিয়ে কিছুক্ষণ
সময় নেয় মনকে শক্ত করার জন্য। পাখি সাঁতার জানে না। নদীর বুকের নৌকাঘাটের ওই
ব্রীজটার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লে তার বাঁচার আশা আর থাকবে না সে খুব ভালোই বুঝতে
পারে। একবার
পেছনে তাকায়, একবার
সামনে। নিস্তব্ধ রাত্রির সূচীছিদ্র কালিমা
তাকে ব্যঙ্গ করে। দূর রাস্থার রাতজাগা কুকুরের চীৎকার তাকে তিরষ্কার করে। ফাঁকা
পরিবেশের শন্শন্ বাতাস তাকে অট্টহাস্য শোনায়।
পাখি চোখ বুঁজে নদী বক্ষে ঝাঁপ দেয়।
নদীর কাল রাত্রির কালো জল পাখিকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে। পাখি জল খায় পেট ভরে। শূন্যে হাত তুলে বাতাস
আাঁকড়ায়, শেষে ডুবে যায় অমাবস্যার রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে, নদীর বুকে।
(২)
মাঝে আটটা বছর কেটে
যায় এক এক করে। কলকাতার এক সুসজ্জিত শপিং
মলে সন্ধ্যার স্বপ্নিল পরিবেশে প্রকৃতির সামনে যে সুন্দুরী পৃথুলা মহিলাটা হঠাৎই
জামা কাপড়ের সারির মাঝ থেকে আবির্ভূত হয় তাকে দেখে প্রকৃতির শরীরটা কেমন কেঁপে
ওঠে। সে মনে মনে চমকে ওঠে। গায়ে তার কাঁটা দিয়ে যায়। রক্ত স্রোত যেন হঠাৎই দ্রুত হয়ে যায়। অজান্তে মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে একটা শব্দ –
‘পাখি-ই-ই-তু-ই!’
প্রকৃতিকে দেখে
পাখিও যে চিনতে পারে না তা নয়। মাঝের
এতগুলো বছর কমবয়সের বালখিল্যতাকে হজম করে নিয়েছে অনায়াসেই। তাই পাখিও ঝগড়ার কথা
ভুলে অবাক বিশ্ময়ে বলে ওঠ – ‘প্র-কৃ-তি-তু-ই!’
প্রকৃতি নিজেকে
সামলে নিয়ে বলে – ‘আমার এখানে আসাটা তো অবাক হবার কিছু নয়? কিন্তু তুই তো অনেকদিন
আগেই.......’
পাখি প্রকৃতির
মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলে –‘মরে গেছি। ভূত! তাই তো? না, রে, আমি মরিনি, ভূতও নই।
বিশ্বাস না হলে গায়ে চিমটি কেটে দেখ। আর এটা তো ঠিক, ভূত হয়ে কেউ এই ভর
সন্ধ্যেবেলা এত আলোর মধ্যে শপিংমলে ঘুরে বেড়ায় না’। পাখি হাসে। একটু থেমে বলে –
‘দাঁড়া আগে তোর সঙ্গে ঝগড়াটা কাট্টি করে ভাব করি, তারপর সব খুলে বলব। চ্, কফি শপে
গিয়ে বসি, তারপরে কথা হবে’।
মুখোমুখি দুই
বন্ধু অনেক বছর পর। পাখি আর প্রকৃতি। প্রকৃতির স্মার্ট ফোনে কল আসল। প্রকৃতি নীচুস্বরে দু’একটা কথা বলে ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। ফোনের বড় স্ক্রীনে ভেসে ওঠে
প্রকৃতি, বসন্ত আর একটা ছোট্টো মেয়ের ছবি। পাখি ছবিটার দিকে তাকায়। প্রকৃতি বলে –
‘তোর বসন্তকে মনে আছে? ওর সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। আর ওটা আমাদের একমাত্র মেয়ে
ফাল্গুনী। বসন্ত চাটার্ড অ্যাকাউণ্ট্যান্ট। ফাল্গুনী ক্লাস ফোরের ছাত্রী, ইংলীশ
মিডিয়াম স্কুলের। আমি কিন্তু গৃহবধূ নই । বাংলা মাধ্যম উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের
শিক্ষিকা। এই কয় বছর আমাদের অনেকটাই বদলে দিয়েছে। আমরা এখন কলকাতার বাসিন্দা ।
বসন্ত ফ্ল্যাট কিনেছে। মফস্বলে আর
শিকড়ের টান নেই। যাতায়াতও নেই। জমি-জমাও নেই, সব বিক্রী করে দেওয়া হয়েছে। বসন্তর বাবা আর মা মারা যাবার সাথে
সাথেই সব সম্পর্ক চুকে গেছে ওখানকার সঙ্গে। দুদিক সামলান সম্ভব হচ্ছিল না’।
পাখি কফির কাপে
চুমুক দিয়ে ওর হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে ট্যাব বার করে স্ক্রীনের আলো জ্বালিয়ে একটা ওয়াল
পেপার প্রকৃতির দিকে তুলে দেখায়। মুখে বলে
– ‘আমার স্বামী বিতান, আমি আর আমার ছেলে বিহঙ্গ। বিতান এই শপিং মলেই কাজ করে ।
বিহঙ্গ-র বয়স ছয় ছুঁল’।
প্রকৃতি একটু
জোরেই কথা বলে ওঠ – ‘বলিস কিরে! কিন্তু এসব হল কি করে? আমার কাছে সব কিন্তু কিরকম
ঘোলাটে লাগছে’।
পাখি মুচকি হেসে বলে – ‘সবটাই ভোজবাজি। কথায় বলে
না – রাখে হরি মারে কে? এটাও সেরকমই। সেদিন আমিই নিজেকে শেষ করার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়ে ছিলাম ঠিকই; আর
কিছুক্ষণ দেরী হলে হয়ত আমার জীবন সেদিন সেখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আমার কপালে
যা লেখা আছে তা আর মুছে যায় কি করে? আমি
যখন জলে পড়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছি, আস্থে আস্থে আমার চোখের সামনে সমস্থ চরাচর যেন
অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে নদীর জলের তোড়ে; স্রোতের জল
মুখের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করছে পাকস্থলিতে, ঠিক তখনই একটা পরিতক্ত গাড়ীর টায়ার
ভাসমান অবস্থায় আমার সামনে এসে পড়ায় আমি প্রাণপন শক্তিতে তাকে আঁকড়ে ধরে এক বুক
অক্সিজেন নেবার জন্য মুখটা জল থেকে আকাশের দিকে উঁচু করে বাড়িয়ে দিই। তাতেই আমার
প্রাণশক্তি বেড়ে ওঠে। তাজা অক্সিজেন আমার পরিশ্রান্ত ফুসফুসকে চাঙ্গা করে তোলে।
আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি। আমি ওই টায়ার ধরে ভাসতে ভাসতে ডাঙ্গায় এসে উঠি। তখন আমার
শক্তি হীন শরীরের সঙ্গে মনটাও নিস্তেজ হয়ে গেছে। মন থেকে মরার ইচ্ছা পালিয়েছে
অচিরেই, মনে তখন একটাই চিন্তা – আমি বাঁচব। ওই অবস্থায় আমি সেখানেই শুয়ে পড়ি।
ক্লান্ত শরীরটা কখন যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে বুঝতে পারি না। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখি
আমাকে নিয়ে দুটি পুরুষ চট্কাচট্কি করছে। তারা আমার শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায়
হাত দিচ্ছে। চুমু খাচ্ছে। আমি তাদের মুখে
মদের গন্ধ পাই। বুঝি মদের ঘোরে তারা আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে। রাত তখন অনেক
বলেই মনে হয় আমার। কিন্তু আমি তাদের বাধা দিতে পারি না। আমার শরীরের শেষ শক্তিটুকু
তখন নদীর জলে ধূয়ে গেছে। গলা দিয়ে আমার আওয়াজ বেরচ্ছে না। দুই মাতাল আমায় ধর্ষন
করে একে একে। আমি সহ্য করি, প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারি না। বেদনায় আমার
শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে, তবু আমি মরি না। এভাবেই সকাল হয়ে আসতে থাকে। মাতালগুলো আমায় ভক্ষণ করে চলে যায় নিজের
রাস্থায়। আমি অতি কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে উঠি
দাঁড়াই শুধু সকালের আলোয় মানুষের সামনে পড়ার লজ্জায়। নদীর জলে কোনরকমে চোখ মুখ
ধূয়ে টলতে টলতে সকাল হবার আগেই ষ্টেশনে এসে কোলকাতার ট্রেনে চেপে বসি শুধু নিজেকে
লুকাবার জন্য’। - একটু থামে পাখি।
পুনরায় পাখি
বলতে থাকে - ‘নিজের প্রতি একটা অনীহা তো অনেকদিন থেকেই চেপে বসেছিল। তাই সেদিন আর
বাড়ীর দিকে পা না বাড়িয়ে আমি সোজা কোলকাতার বেশ্যাপল্লীতে এসে উঠি। সমস্থ কথা ওখানকার মাসীকে খুলে বলে একটু আশ্রয় চাই।
পেয়েও যাই আশ্রয়। আমি ওদের লোক হয়ে যাই। শরীর বেচা কেনার ব্যাপারী হয়ে জীবন কাটাতে
থাকি’।
‘কিন্তু এই
জীবনও আমার বেশিদিন টেঁকে না। বিতান আমার ঘরে আসত প্রায়ই। সেই আমায় ভালোবেসে ফেলে
কখন। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রথমে আমি রাজী হইনি। কিন্তু বিতানের জেদের কাছে
একদিন বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। আমি আবার একদিন মধ্যরাত্রে সেখান থেকে পালিয়ে যাই।
বিতানের তিনকূলে কেউ নেই। শপিং মলেই তার বাড়ী ঘর। বিতান আমাকে এখানে এনে তোলে।
আমরা এখন এখানেই থাকি। শপিংমলের বাঁদিকের একটা
ঘরে আমাদের সংসার। বিতানের সঙ্গে আমিও এখানকার একজন সেলসগার্ল। আমরা এখন
বেশ সুখেই আছি। বিতান আমায়
ভালোবাসে। এখন মনে হয় সব পুরুষ খারাপ নয়, মেয়েদের ভাগ্যটাই খারাপ হয়’।
একটানা কথা বলে
থামে পাখি। কফির কাপ শেষ করে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বলে – ‘আমাদের ভাঙ্গা
বন্ধুত্বটা তুই জোড়া লাগাতে পারিস, যদি তুই মনে করিস। অবশ্য আমি তো এখন সেই আগের
পাখি নেই। যাক্, যদি মনে করিস বন্ধুত্ব করবি তবে ফেসবুকে আবার দেখা হবে। আমার
প্রোফাইলে এখন কিন্তু বিতানের ছবি দেওয়া
আছে। কভার পেজে পাবি বিহঙ্গর ছবি। একটু দাঁড়া, আমি আমার মেল আই.ডি. আর ফোন নম্বরটা
তোকে দিচ্ছি। বন্ধুত্ব করতে চাইলে সার্চ
করে রিকোয়েষ্ট পাঠাস। যদিও তোর সামাজিক স্টাটাসের সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য, তাই
তুই বন্ধুত্ব করলেই তবে আমি তোর বন্ধু হব, নতুবা আমার মত মেয়ের সাথে তোকে জড়াব না।
আর হ্যাঁ, আজকের কফির দামটা কিন্তু আমার, আমার ছোটোবেলার বন্ধুর জন্য, কেমন?’
পাখি মোবাইলে
ঘড়ি দেখে। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বলে – ‘ আমি এবার যাইরে, অনেকক্ষন কাউণ্টার ছেড়ে
আছি, তুই আবার আসিস্, যদি মনে করিস্। তবে, এবার আসার সময় আগে জানিয়ে আসিস্’।
পাখি একটা সাদা
কাগজে মেল আই.ডি. আর ফোন নম্বর লিখে প্রকৃতির হাতে তুলে দিয়ে বলে – ‘আসি বন্ধু,
আবার দেখা হবে’।
পাখি চলে যায়
শপিং মলে তার নির্দিষ্ট জায়গার দিকে। প্রকৃতি একা কফি শপের মধ্যে দাঁড়িবে থাকে তার
চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে। মনে মনে ভাবে জীবন বড়ই বিচিত্র, কতই না তার রূপ, রস,
গন্ধ।
তার চোখের সামনে
শপিং মলের আলোর রোশনাই নিভে যায়। শুধু সেই অনেক পুরনো পাখির একহারা চেহারাটা ভেসে
ওঠে, যা এখনকার পাখির সঙ্গে মেলাতে পারে না সে। শুধুই চেয়ে থাকে, আর চেয়েই থাকে।
=======
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন