মৃত্যু আলিঙ্গিত নিশীথ
- পার্থ ঘোষ
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর ।
কিশোর অর্ক মামার বাড়ির স্নেহ ভালোবাসা গায়ে মেখে যুবক হয়ে উঠেছে । ওর সামনে এখন কিশোর পৃথিবী হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ।
যে পৃথিবীকে প্রাপ্তবয়স্কর রঙীন চোখে দেখার সৌভাগ্য অনেকদিন আগেই হারাতে পারত অর্ক । কিন্তু মা-বাবার আশীর্ব্বাদ আর ভগবানের কৃপায়
সে এখনো এই পৃথিবীর একজন জীবন্ত অংশীদার । এরজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে অর্ক । মামার বাড়ির উজাড় করা ভালোবাসা পুরানো দিনের কষ্টকে ফিকে করে দিয়েছে
ঠিকই কিন্তু মুছে দিতে পারেনি ওর মন থেকে ।
অর্ক জানে সেটা সম্ভবও নয় কোনোদিন
। যৌবনদীপ্ত সবুজ মনের অন্ধ কোণে একটা কালো কাঁটা বহন করে চলেছে অর্ক সেই কৈশোরের
শুরু থেকে । সে জানে চিরজীবন ওই কাঁটা বয়ে
চলতে হবে তাকে । পৃথিবীর কোনো ডাক্তারের
ক্ষমতা নেই তুলে দিতে পারে ওই কাঁটাটাকে ।
নিত্যসঙ্গী সেই কাঁটা নিত্যদিন তার উপস্থিতি জানান দেয় অর্ক কে । তখন হারিয়ে যায় অর্ক । পিছিয়ে যায় আজ থেকে দশ বছর আগের সেই অভিশপ্ত
রাতে । যে রাতে মৃত্যু ডানা বিছিয়ে দিয়েছিল ওদের পাঁচজনের ওপর । শকুনের মত ধারাল ঠোঁটে করে ছিনিয়ে নিয়েছিল
চারজনকে । শুধু ভাগ্যবান অর্ক ছি্টকে
গেছিল মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে ভগবানের কৃপায় ।
জ্ঞান হারাবার আগে জীবনে প্রথমবার প্রত্যক্ষ করেছিল মৃত্যুর সেই বীভৎস রূপ
। যা আজও স্বপ্নে কখনও কখনও টেলিফিল্মের মত ভেসে ওঠে চোখের সামনে,
স্মৃতির পর্দায়।
বাবা, মা, অর্ক আর ছোট বোন অলি চারজনের ছোট্ট সংসারটা সেদিন মেতে উঠেছিল
দীঘা যাবার আনন্দে । অনেকদিনের জল্পনা,
কল্পনার অবসান হয়েছিল যখন সাদা রঙের টাটা সুমোটা রওনা দিয়েছিল দীঘার উদ্দেশ্যে। অষ্টম
শ্রেণীর অর্ক আর চতুর্থ শ্রেণীর অলির মনে তখন খুশির জোয়ার। প্রতিদিনের বাঁধা ছকের বাইরে বেরিয়ে তখন ওরা
ছন্দহারা । ওদের দৃষ্টি তখন ড্রাইভার
কাকুর পাশ দিয়ে গাড়ির হেডলাইট অনুসরন করে রাজপথের মসৃণ দেহে পিছলে যাচ্ছে । ওরা
তখন খেলায় মেতেছে । সুমোর পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিবেগে চলে যাওয়া গাড়িগুলোকে একের পর
এক গুনতি করতে ব্যস্ত ভাইবোনে । ড্রাইভারকাকুর হাতে স্টিয়ারিং তখন শক্ত করে ধরা ,
অপলক দৃষ্টি বিস্তৃত রাস্তা বরাবর । স্পীডোমিটারের কাঁটা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠছে ।
গাড়ি ছুটছে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ।
প্রচণ্ড দক্ষতায় এক একটা গাড়িকে
পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অর্কদের সাদা পক্ষীরাজ ।
নিকষ কালো অন্ধকারের বুক ফালা ফালা করে চিড়ে দিয়ে গাড়ির হেডলাইট দূরে ছড়িয়ে পড়ছে
। চারধারের জমাট অন্ধকার যেন গ্রাস করতে
চাইছে দুরন্ত গাড়িগুলোকে। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে সাংসারিক আলোচনায়
ব্যস্ত। সেসব কথা কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না অর্ক আর অলির। খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে
তারা ।
সুমো ছুটে চলেছে প্রচণ্ড গতিবেগে । হঠাৎই একটা মারুতিকে পাশ কাটিয়ে সুমোটা
একটা লরির পেছনে এসে পড়ল । হৈ হৈ করে উঠল
দুই ভাইবোন, আনন্দে । ড্রাইভার কাকুর হাত স্টিয়ারিঙে । দৃষ্টি সামনে অপলক । চেষ্টা করছে লরিটাকে ওভারটেক করার জন্য, কিন্তু পারছে না। ডানদিক দিয়ে সমান
গতিবেগে সুমোকে ঢুকিয়ে দিল ড্রাইভারকাকু ।
গতি বাড়াল গাড়ির । উল্টোদিকে দূর
থেকে একটা বিশাল ট্রাক ছুটে আসছে । ক্রমশঃ
কমে আসছে দূরত্ব । সুমো ছুটতে শুরু করল আরও জোরে । দূরের ট্রাকটা আসার আগে পাশের লরিটাকে অতিক্রম
করতেই হবে । আরও গতি বাড়ল সুমোর । লরি আর
সুমো প্রায় সমান গতিতে চলছে । আর একটু গতি না বাড়ালে অতিক্রম করা যাবে না লরিটাকে
। তাই সুমোর গতি আরও বাড়াল ড্রাইভারকাকু ।
আর একটু যেতে পারলেই লরিটাকে অতিক্রম করবে সুমো ।
হঠাৎই সুমোর থেকে একহাত দূরে এসে পড়ল উল্টোদিক থেকে প্রচন্ড বেগে আসা ট্রাকটা। অর্ক দেখল বিশাল এক দানবের মত গ্রাস করে নিল
সুমোটাকে । বিকট আওয়াজে আর ধাক্কায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল অর্ক ।
কতক্ষণ ওভাবে কেটেছিল জানতে পারেনি অর্ক । যখন হুঁশ ফিরেছিল চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট
কণ্ঠস্বর কানে এসেছিল । জমাট অন্ধকারের
চাদর ভেদ করে দূরের হাইওয়ের ওপরে যানবাহনের যান্ত্রিক আওয়াজ আর হেডলাইটের আলোর গতি
অনুভব করেছিল । সবই কেমন ঝাপ্সা লাগছিল যাতনাময় শরীরের অনুভূতিতে । যন্ত্রণায়
ফেটে যাচ্ছিল সারা শরীর । জ্বালা করছিল সমস্ত দেহটা । হাত-পা
নাড়াবার কোন ক্ষমতা ছিল না । নাক বরাবর
চটচটে জলীয় পদার্থ গড়িয়ে পড়ছিল মুখে; যার স্বাদ ছিল নোন্তা । মাথাটা যন্ত্রণায় যেন টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছিল
। আবছা অনুভূতিতে বুঝেছিল নরম মাটির স্তূপে পড়ে আছে সে । মানুষের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর
ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল তার দিকে । শরীরটাকে
নাড়াতে গিয়ে প্রচণ্ড বেদনা অনুভব করেছিল সে ।
মনে হয়েছিল এক্ষুনি মরে যাবে ।
চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল মুখ দিয়ে অনায়াসে । পরক্ষনেই সমস্ত চরাচর
হারিয়ে গিয়েছিল জৈবিক অনুভূতি থেকে ।
যখন জ্ঞান এসেছিল, দেখেছিল সারা গায়ে ব্যাণ্ডেজ
বেঁধে শুয়ে আছে বিছানায় । প্রথমটায় অবাক
হলেও পরে বুঝেছিল এটা হাস্পাতাল । সারা দেহ কুঁকড়ে যাচ্ছিল যন্ত্রণায় । মাথার
ভেতরটা কি রকম ফাঁকা লাগছিল , সারা শরীর যে ব্যাণ্ডেজে মোড়া রয়েছে বুঝতে পারছিল শুয়ে
শুয়েই । ক্রমশঃ সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল অর্কর ।
গত রাতের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়তেই বাবা, মা, বোন আর ড্রাইভার কাকুর মুখগুলো
একে একে ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে । নিজের
অবস্থা দেখে ওঁদের জন্য উৎকণ্ঠা তীব্র হয়েছিল যন্ত্রণাক্লীষ্ট অসাঢ় মাথার মধ্যে ।
চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল জলের ধারা ।
হাস্পাতালে যতদিন অর্ক চিকিৎসাধীন ছিল ততদিন ওকে
বলা হয়েছিল – অন্যরা সকলে অসুস্থ এবং এই হাসপাতালে ভর্ত্তি আছে । অর্কর হাত, পা,
বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গিয়েছিল । মাথার আঘাতও ছিল প্রচণ্ড । মাথা ফেটে যাওয়ায় অনেক
রক্তক্ষরণও হয়েছিল । ঠিক সময়ে গ্রামের লোকেরা ওকে হাসপাতালে ভর্তি না করলে
মৃত্যুকে এড়াতে পারত না অর্ক ।
মামার বাড়ির ঠিকানা অর্কর কাছ থেকে জেনে খবর পাঠান
হয়েছিল হাস্পাতাল থেকে । তারপর থেকে মামারা প্রতিদিন হাস্পাতালে আসত
। পরে হাস্পাতাল থেকে ছুটি দেবার পর
অর্কর নতুন ঠিকানা হয়েছিল মামার বাড়ি । ক্রমশঃ জানতে পেরেছিল ওই বিভীষিকাময় রাতের
দীঘাভিমুখী মারণ যাত্রায় সেই বিশাল ট্রাকটার করাল গ্রাসে অর্ক ছাড়া অন্য সবারই
প্রাণহানি হয়েছিল । কোনরকমে গাড়ি থেকে
বাইরে ছিট্কে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছিল অর্ক, না হলে আজ তার ছবিও ঝুলে থাকত ফুলের
মালায় সজ্জিত হয়ে বাবা, মা আর বোনের ছবির মাঝে মামার বাড়ির ডিস্টেম্পার করা
দেওয়ালে ।
সেই পুরানো স্মৃতি আজও অর্ককে ঘিরে আছে, থাকবে
চিরটাকাল । এ ঘটনা ভোলার নয় । এ যে নিজের জীবন দিয়ে দেখা । প্রিয়জন হারানোর দুঃখ আর ভয়ংকর মৃত্যুর কালো
রূপ, দুটোই যে আজ তার যুবক হৃদয়ে বিঁধে আছে কাঁটার মত । এই কাঁটা তোলার মত ডাক্তারের আবির্ভাব এখনও
ঘটেনি পৃথিবীর বুকে । সেজন্যই সেই কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে
অর্কর কোমল তরুণ হৃদয় । পরিচিত রাতের আঁধারে দুঃস্বপ্ন হয়ে দু’চোখের ওপর চেপে বসে সেই অভিশপ্ত কালো
রাত আজও; এত বছর পরেও ।
_________ ()___________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন