------------------------------------------------পার্থ ঘোষ
স্বচ্ছ নীলাকাশের
দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের শ্বেত-শুভ্র ব্যাপ্তি।
ওরা চঞ্চল। শরতের নির্মল বাতাসে কাশবনে খুশির জোয়ার। মাথার ওপরের বিশাল নীলিমার দিকে চেয়ে চেয়ে তারা
উৎফুল্ল, আনন্দিত। মলয় বাতাসের দোলায় অবিন্যস্ত, উচ্ছ্বসিত এবং
খুশির জোয়ারে প্লাবিত।
মা আসছেন। দশভূজা
মা, আমাদের বিন্দুবাসিনী মা – দুর্গতিনাশিনী দূর্গা। চারিদিকে সাজ-সাজ রব। নতুন করে সাজার আনন্দ। অশুভ শক্তিকে বিনাশ আর
শুভ শক্তির অভ্যুত্থানের এক বিজাতীয় সহবস্থান।
মৃৎশিল্পী গণেশ পাল
আজ পরিণত মনস্ক মানুষ। শিল্পীর শিল্প-কৌশল
তার চোখে, হাতে, আঙুলে আর সর্বোপরি মনের গভীরে।
শিল্পী সত্তার বহিঃপ্রকাশ মৃন্ময়ী দশভূজার মাতৃমুর্ত্তিতে।
পূজোর আর দশদিন
বাকি। শিল্পী গণেশ সিংহবাহিনী, অসুরনাশিনী,
পুত্র-কন্যা পরিবৃতা দূর্গা মূর্তিকে সজ্জিত করার কঠোর পরিশ্রমে বিভোর। বিস্মৃত প্রায় আহার-নিদ্রা।
বাবার মত শিল্পী হতে
চায় গণেশ। নিখুঁত শিল্প তৈরী করা ভগবানেরও
অসাধ্য একথা জানে সে, তবু চেষ্টা করে যায়।
উজাড় করে দেয় তার শিক্ষার সমস্ত গোপন রহস্য। মনপ্রাণ দিয়ে তৈরি করে যায় একের পর এক
দূর্গা প্রতিমা।
কঠোর পরিশ্রম আর
নিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করা প্রতিমাগুলি যখন একে একে ঘর ফাঁকা করে চলে যায় শহরের বিভিন্ন
মণ্ডপে, গণেশের তখন মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে।
পাকা ধান কেটে নেবার পর ধান জমির বুকটা যেমন ভরে যায় শূণ্যতায়, ঠিক সেরকম।
শিল্পী গণেশের মনটা কখন দুঃখে ভরে যায়। মনে হয় কে যেন একটা একটা করে বুকের কলিজাগুলো
খুলে নিয়ে যাচ্ছে। বড় ফাঁকা লাগে। প্রতিবছরে একই রকম অনুভূতি। তবু গণেশকে কষ্ট করে প্রতিমা গড়তে হয় আবার
দুঃখও পেতে হয়। এটাই যে তার রুজি
রোজগার। আবার এক ধরনের সৃষ্টির আনন্দও পায়
সে। নিজের তৈরি প্রতিমা যখন
স্বয়ংসম্পূর্ণা হয়ে কোন মণ্ডপে পূজিত হয় তখন গণেশ এক নতুন স্বাদের আনন্দ উপভোগ
করে। তার বুক ভরে ওঠে বাৎসল্য রসে। গর্ব হয় তার, ভগবানকে সে প্রণাম জানায় তার এই
সৃষ্টি করার অসীম ক্ষমতার জন্যে।
কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয় স্বর্গীয় পিতা মহাদেব পালের কাছে। গণেশকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন তিনি। অসম্ভব সুন্দর ঠাকুর গড়তেন শিল্পী মহাদেব। তাঁর প্রতিমা কথা বলত – লোকে এমনই বলত। গণেশ এখনও অতবড় শিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষমতায়
ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেনি – চেষ্টা করে চলেছে।
শিল্পী মহাদেব পাল
মারা গিয়েছিলেন হঠাৎই। সেটাও ছিল এমনই
শরৎকাল। আজকের চল্লিশের গণেশ তখন ত্রিশের
যুবক। তুলির টানে দূর্গার দৃষ্টিদান করার
সময়ই প্রথমে হাত থেকে রঙ মাখান তুলি খসে পড়েছিল সিংহের দু’চোখের মাঝের কপালে। গণেশ তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রঙের বাটি হাতে
ধরে।
গণেশের নজর পড়েছিল
বাবার দিকে। শিল্পী মহাদেব তখন সংজ্ঞাহীন
হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। রঙের বাটি ফেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল গণেশ। ডেকে উঠিছিল ‘বাবা’ বলে । একটু যেন ঠোঁট দুটো নড়ে উঠেছিল মৃৎশিল্পীর,
তারপর শিল্পের কারখানায় শিল্পীর অচৈতন্য দেহ ভবিষ্যৎ শিল্পীর আলিঙ্গনে নিথর হয়ে
গিয়েছিল চিরকালের মত। গণেশ দেখেছিল তার বাবার
হাতের তৈরী প্রতিমারা তার বাবার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল দূর্গা প্রতিমা যেন দশ হাত তুলে
আশীর্ব্বাদ করছেন তাঁদের শিল্পীকে। শিল্পী
বেঁচে থাকে তার শিল্পের মাধ্যমে। গণেশ
অনুভব করেছিল বাবার শরীরের রক্তমাংস তার শরীরে বিরাজমান, তাই বাবার শিল্পকে
বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও তাই তার। বাবার
অসমাপ্ত কাজ সে বছর গণেশই শেষ করেছিল। সহ
শিল্পী হিসেবে কার্তিককে সঙ্গী করে।
গণেশের ছোটো ভাই কার্তিক। তখন তার
বয়স ছিল কুড়ি বছর। গণেশের শিক্ষায় আজ সে
ভবিষ্যতের শিল্পী।
তবু কার্তিকের মধ্যে
গণেশ শিল্পী সত্তার ঘাটতি দেখতে পায়। তার
মনে হয় কার্তিক যেন এই প্রতিমা তৈরীর ব্যাপারটা উপার্জনের একটা
পথ হিসাবে দেখে। প্রতিমা তৈরী করার থেকে
বিক্রির দিকেই তার মন বেশি। গণেশ অনুভব
করে কার্তিক অপেক্ষা করে থাকে কবে পূজা কমিটির লোকেরা এসে
মৃন্ময়ী প্রতিমাগুলোকে নিয়ে যাবে পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে; গণেশের এটা পছন্দ হয়
না। শিল্পীর শিল্প চড়া দামে বিক্রি হবে এটা শিল্পীর কাছে খুবই আনন্দের সেটা যেমন সত্য তেমনি শিল্পের প্রতি শিল্পীর অপত্য
স্নেহ, এটাও তেমনই সত্য। সন্তান বিদেশে পড়তে গেলে যেমন বাবা-মার আনন্দ হওয়াই স্বাভাবিক, তেমনি দিনের পর দিন বিদেশে পড়ে থাকা
পাঠরত সন্তানের জন্য যে বিরহ ব্যথা, তাও তেমনিই কষ্টকর বিক্রিত শিল্পের বিয়োগ
ব্যাথার মতই।
গণেশ কার্তিককে এসব বোঝাতে পারে না; কার্তিক বুঝতেও চায় না।
শিল্পী গণেশ প্রতিমা
নিরঞ্জন দেখতে যায় না। তার বড় দুঃখ
লাগে। মনে হয় কে যেন তার হৃদয়টাকে উপড়ে
ফেলতে চাইছে। বড় কষ্ট লাগে। প্রাণপাত
পরিশ্রম করে তৈরি করা নিজের সন্তানসম মূর্ত্তিগুলোর এ হেন পরিণতি গণেশকে কষ্ট
দেয়। তাই বিজয়া দশমীর ঢাকের আওয়াজ, জনতার
উল্লাস, শব্দ বাজীর শব্দ গণেশের কানে বলির পাঁঠার শেষ চিৎকারের মত মৃত্যুভয় মাখা
ক্রন্দন ধ্বনির ন্যায় আঘাত করে। গণেশ সহ্য
করতে পারে না।
শিল্পী হবার পর
একবারই সে বিসর্জন দেখতে গিয়েছিল কার্তিকের সঙ্গে। সেই শেষবার। মনটা তার টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল দশভূজার সলিল
সমাধির সাক্ষী হয়ে। সন্ধ্যাকালের গঙ্গার
ঘাটে মশালের আলোয় ডুবন্ত দূর্গার স্বর্ণাবয়ব মুখটা শুধু জলের ওপর ভাসতে দেখে চোখে
জল এসে গিয়েছিল গণেশের। দৌড়ে পালিয়ে
এসেছিল সে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দু’হাতে চোখ ঢেকে শুয়ে পড়েছিল তার মাটির গন্ধ
মাখানো বিছানায়। চোখের জলে ভেসে গিয়েছিল
বিছানার চাদর। গণেশ সহ্য করতে পারেনি তার
শিল্পের অপমৃত্যু।
বিজয়া শেষে কার্তিক এসে গণেশকে ডেকে তুলেছিল বিছানা থেকে, বিজয়ার
প্রণামের জন্য। গণেশ উঠে দাঁড়িয়েছিল, তখন
তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। কার্তিক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল। গণেশ দেখেছিল কার্ত্তিকের মুখে বিষাদের কোন
চিহ্ন নেই। শিল্পীর মনে দাগ কাটেনি তার
শিল্পের বিনাশ। গণেশ বুঝেছিল কার্তিক শিল্পী হয়ে ওঠেনি। মৃৎশিল্পী গণেশের জ্বর তপ্ত
শৈল্পিক করতল স্পর্শ করেছিল কার্তিকের
মাথা । আশীর্ব্বাদ করেছিল গণেশ তার ছোটো ভাইকে – ভগবান তোকে শিল্পী করে যেন গড়ে
তোলেন।
দু ফোঁটা উষ্ণ অশ্রু
গড়িয়ে পড়েছিল গণেশের দু’গাল বেয়ে।
অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে হারিয়ে গেছিল কার্তিকের অবিন্যস্ত রেশম কালো চুলের গভীরে, কার্তিকের অজান্তেই।
ভায়ের মাথায় বর্ষিত
হয়েছিল শিল্পী দাদার শৈল্পিক আশীর্ব্বাদ বিজয়া দশমীর বিষন্ন সন্ধ্যায়। সেই থেকে
এখনও প্রতিবছর গণেশ কার্তিককে একই আশীর্ব্বাদ
করে যায় বিজয়ার প্রণামের পর।
গণেশ কার্ত্তিককে
শিল্পী করতে চায়, তার মধ্যে বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার
জন্য।
গণেশের শিল্পী
দরকার, ব্যবসায়ী নয়।
-----
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন