আপেক্ষিক- আদিত্য
‘’ তোমার কিসের এত অহংকার?’’
‘’ কোথায় অহংকার ?’’
‘’ প্রতি মুহূর্তে তো সেটাই দেখাচ্ছ!’’
‘’ কখন দেখালাম ?’’
‘’ কাল সারাদিন রিপ্লাই দাওনি! যখন দেখা করতে গেছি, এড়িয়ে গেছো, বলেছ ব্যস্ত আছি।‘’
‘’ আবার বাচ্চাদের মতো করছিস। তুই নিজেই দেখেছিস, কাল বাড়িতে লোকজন এসেছিল। তারমধ্যে মেয়েটার জ্বর এসেছে, কখন কথা বলব বল।‘’
‘’ সেটা কালকের ঘটনা, কিন্তু বাকি দিনগুলোও এইভাবেই কাটিয়ে দাও। ‘’
‘’ তুই আবার বাজে কথা শুরু করলি, এই জন্যই…’’
‘’ জানি তুমি কী বলবে! এই জন্যই আমার সঙ্গে থাকতে তোমার ভাল লাগে না। তাহলে আছো
কেন? কয়েকটা গালাগাল দিয়ে চলে যেতে পারো তো!’’
‘’ তুই কিন্তু এবার বারাবারি করছিস।‘’
‘’ কিচ্ছু করছি না! যা বলেছি , একদম ঠিকই বলেছি।‘’
‘’ আমি কিন্তু সত্যি চলে যাব।‘’
‘’ যাও না, কেউ তো তোমায় আটকে রাখেনি।‘’
তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এই সময়টা
আমাদের হাঁটার সময়। প্রত্যেকদিন আমরা একই বাড়ি থেকে দুটো আলাদা দরজা দিয়ে বেড়ই। আমরা
যে রাস্তাটা ব্যবহার করি, মোটামুটি সেই রাস্তাটা ফাঁকাই থাকে কিন্তু আজ রাস্তায় বেশ
ভিড়। কিছু লোকজন আমাদের অবৈধ ঝগড়াটা বেশ উপভোগ করছে। জয়ীর মেজাজটা আজ বাংলার পাঁচের
মতো, আমিও বেকারত্বের জ্বালায় একবারে ঘেঁটে গেছি।
তবে আমাদের চলার গতি কিন্তু কমেনি। চলতে চলতেই কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমারা দুজন
দুজনের দিকে না তাকিয়েই কথা বলে চলেছি। আমাদের দৃষ্টি কিন্তু সামনের দিকে, হয়ত আমাদের
ভবিষ্যৎ-এর দিকে!
“ তুই কিন্তু আজ খুব উল্টো-পাল্টা বকছিস!’’
‘’ তুমি আর কথা বলো না। উল্টো-পাল্টা কে বকছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে! কার কিসের প্রয়োজন,
সবই জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।‘’
‘’ এবার কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই চলে যাব।‘’
‘’ ভয় দেখিও না। তোমাকে আমার চেনার আর বাকি নেই। তুমি শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে খিল্লি
করো আর অসময়ের সঙ্গী ভেবে সময় কাটাও। আমাদের মধ্যে কোনও ভালবাসা নেই। সব মিথ্যে, সব
নাটক!’’
এতক্ষণে জয়ী আমার মুখের দিকে তাকাল। হাঁটার গতিও অনেক কমে এসেছে। আমি ওর মুখের
দিকে চাইতেই দেখলাম, মুখটা রাগে লাল হয়ে এসেছে, হয়ত এবার সত্যি সত্যিই চলে যাবে! কিন্তু
জয়ী কিছু বলল না, আবার সামনের দিকে তাকিয়ে আগের গতিতেই হাঁটতে শুরু করল। আমিই আবার কথা শুরু করলাম, ‘’ চুপ করে থাকলে কেন?
উত্তর দাও!
‘’ আমার সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বললি না!’’
‘’ কেন ? তোমার মতো পেটে বিদ্যে নেই বলে ? নাকি তোমার মতো কাউকে নিয়ে খিল্লি করতে
পারি না বলে ?’
’
জয়ী এবার হঠাৎ থেমে গেলো। আশেপাশে তখন
বেশ পথ চলতি মানুষ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হওয়ার পালা। জয়ী বেশ ভারী গলায় বলল, ‘’ তুই
জানিস রাস্তার মধ্যে আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। শুধু তাই নয়, মাঝ রাস্তায় সিনক্রিয়েট
করাটাও আমি পছন্দ করি না!’’ কথা না বাড়িয়ে জয়ী আবার হাঁটতে শুরু করল। আমিও কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। আমরা হাঁটার পথে
এক জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চা খেতাম, গল্প করতাম। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা একেবারে
অন্যরকম ছিল। আমরা যে পথে গিয়েছিলাম, সেই পথেই ফিরে এলাম। তবে আমরা একটু সময়ের ব্যবধানে
দুটো আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে ঢুকতাম। যাতে আমাদের কেউ সন্দেহ না করে। দুজনেরই মুখ ভার। আমরা কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলছি
না। আমরা সময় মতো বাড়ি ফিরে গেলেও, আমাদের মধ্যে আজ একটা অন্যকিছু চলছে! আমরা হয়ত একে
অন্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না! তবে আমার মাথার মধ্যে একটা কথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে,
জয়ী কি আদেও আমাকে ভালবাসে? নাকি শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করছে?
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমেছে। দুটো ঘরেরই দরজা বন্ধ। জয়ীকে সন্ধ্যের পর আর দেখেনি।
আমারও মনটা অস্থির হয়ে উঠছে। বারবার ফোনের
মেসেজ চেক করছি। একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাচ্ছি। উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করছি।
ঘড়িতে রাত বারোটা দশ। গলির কুকুরগুলোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি শুধু। বাধ্য হয়ে জয়ীকে ফোন করলাম। জয়ী ফোনটা কেটে দিল।
আমি জানতাম, জয়ী মেয়েকে অনেক আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তারপর আমার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু
আজ সবই উল্টো-পাল্টা হচ্ছে। হঠাৎ জয়ী মেসেজ করল, ‘’ কী হয়েছে?’’ আমি রিপ্লাই দিলাম,
‘’ কথা আছে!’’ জয়ী বলল, ‘’ আজ আমার শরীরটা ভাল লাগছে না! কাল যাওয়ার আগে কথা বলব।‘’
আমার হঠাৎ চমক লাগল, যাওয়ার আগে মানে ? জয়ী কোথায় যাচ্ছে ? রিপ্লাই দিলাম , ‘’ কোথায়
যাচ্ছ ?’’ জয়ী উত্তর দিল, ‘’ বাড়ি ফিরে যাব কাল। আমি আর এখানে থাকব না !’’
আমার পৃথিবীটা হঠাৎ কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি ভেঙে পড়লাম। যে আমি বিকেলে জয়ীর
সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য বীরপুরুষ হয়ে গেছিলাম, সেই আমি হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। জয়ীকে
মেসেজ করে বললাম, ‘’ প্লিজ চলে যেও না!’’ কিন্তু জয়ী আর রিপ্লাই দিল না। একবার নয় বহুবার
মেসেজ করেও জয়ী কোনও উত্তর দিল না। বিভিন্ন
প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। একটা ঘোরের মধ্যে রাতটা কেটে গেলো!
যখন সকাল হল, তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে দশটা। বাড়িতে বেশ লোকজনের আওয়াজ পাচ্ছি। আমার
একঝটকায় গতকালের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেলে। বিছানা ছেড়ে একদৌড়ে সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম, জয়ী চলে যাচ্ছে। কাঁধে একটা ব্যাগ
আর কোলে মেয়ে। সামনে একজন জয়ীর সুটকেস নিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে। আমার মনে হল, চিৎকার করে জয়ীকে
ডাকি। কিন্তু পারলাম না! মনে পড়ে গেলো, আমরা একে অন্যকে কথা দিয়েছিলাম, আমাদের
প্রেমটা গোপন থাকবে। জয়ী একবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকাল না। চলে গেলো অভ্যাসের
মতো। আমি সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। মনে হল আমার জীবনটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সব শেষ হয়ে
গেলো।
তারপর আর জয়ী কোনওদিন যোগাযোগ করেনি। হয়ত প্রত্যেকটা অবৈধ প্রেমে,
প্রেমিকেরা সব যন্ত্রণা ভোগ করে। হয়ত সব
বেকারদের কপালে জোটে ভাঙা প্রেম। যখন জয়ী কথা দিয়ে কথা রাখতে পারল না, তাহলে কেন
সেদিন ভালবেসিছিল? কেন প্রশ্নগুলো উত্তর না দিয়েই জয়ী চলে গেলো ? আজও জয়ীর কথা মনে
পড়ে। মনে পড়ে আমাদের প্রেমের কথা। বছর দশকের বড় সেই মেয়েটার কথা। হয়ত আজ জয়ী কোনও
কলেজের প্রফেসর। ছাত্রদের শিক্ষা দিচ্ছে আরও বড় হওয়ার জন্য। আজও হয়ত মদের নেশায়
আমার ভুলেই গেছে আমার অস্তিত্ব। আমাকে ওর জীবন থেকে মুছে দিয়েছে। মুছে দিয়েছে
আমাদের সব সম্পর্ক। জয়ী আজও তোমার জন্য বলি, ‘যেখানেই থেকো, ভাল থেকো! বড্ড ভাল থেকো।
ব্যস আর কিছু চাইনা।‘’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন