না-গল্প
-----------------------------------------পার্থ ঘোষ ---------------------
(১)
দু’চোখে অঝোর ধারায় বারি ঝরছে। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে রয়েছে মেয়েটা, কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে তার পাতলা শরীর।
চোখের জল ছোঁয়াচে। মেয়ের অশ্রুধারা মাকেও কাঁদিয়ে দিচ্ছে।
মায়ের চোখে নামছে শ্রাবণের বারিধারা।
দু’গাল বেয়ে সেই জল আশীর্ব্বাদ হয়ে গড়িয়ে পড়ছে মেয়ের মাথায়।
অশ্রুবেগে কম্পিত হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। মা-মেয়ে ভেসে যায় কান্নার জোয়ারে।
ওরা দুজনেই জানে এ কান্না সুখ ও দুঃখের।
এই নয়নবারিতে মিশে আছে আনন্দ, দুঃখ, পরাজয় আর জয়লাভের মত জীবন সংগ্রাম।
এ অশ্রু দুটি অসহায় মহিলার করুণ জীবনের বহিঃপ্রকাশ। আবার দুই মহিলার জীবন যুদ্ধে জয়লাভের আত্মপ্রকাশ।
(২)
পাঞ্চালীর মতে সায় দিয়ে দেবদত্ত তার প্রথম সন্তানকে মেনে নিতে পারল না। কারণ, মৌবনী কন্যা সন্তান প্রসব করল। আর তাই দেবদত্তও তার স্ত্রীর ওপর রুষ্ট হল। পাঞ্চালী ঠিক এটাই চেয়েছিলেন।
পাঞ্চালীর কন্যা সন্তান অপছন্দ। কন্যা সন্তানে বংশরক্ষা হয়না। যদিও তিনি নিজে মহিলা বলে নিজের ওপর কোন রকম রাগ বা বিতৃষ্ণা আছে কিনা সেটা জানা যায় না ঘুণাক্ষরেও। তিনি তাঁর ছেলেকে সেভাবেই মানুষ করেছেন ছোটো থেকে। দেবদত্ত তাঁর একমাত্র ছেলে। দ্বিতীয়বার চেষ্টায় যদি কন্যা জন্ম হয় তাই তিনি দু’বার মা হবার চেষ্টা থেকে বিরত থেকে গেছেন তাঁর যৌবনে। যদিও দেবদত্তর জায়গায় প্রথমেই কোনো দেবীর জন্ম হলে তিনি তাকে গলা টিপে হত্যা করতেন কিনা সে খবর প্রকাশ পায় না। সেরকম কোন মনোভাব মনের মধ্যে তাঁর যৌবনে কোনদিন বাস বেঁধেছিল কিনা সে সম্বন্ধে তাঁর স্বামী অজিতেশও জানতে পারেন নি তাঁর মৃত্যুর আগে অবধি।
অবশ্য পাঞ্চালীর এহেন কন্যা বিদ্বেষী মানসিক ব্যাধিতে অজিতেশ মনে মনে সুখি
ছিলেন না।
তাঁর একটা কন্যা সন্তানের ইচ্ছা যে কোনদিন পূর্ণ হবে না তা তাঁর জীবদ্দশায় ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই দুঃখ বুকে নিয়েই তিনি মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন প্রেশার ও সুগারের মত ব্যাধিকে আলিঙ্গন করেই।
সংসারে প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল পাঞ্চালীর। তার কথাই শেষ কথা।
অজিতেশের মত নরম মনের মানুষকে গরম দেখিয়ে কিভাবে রাখতে হয় তিনি তা ভালোই জানতেন। দেবদত্তকেও তিনি তাঁর প্রতিপত্তি দিয়েই ভীতু বানিয়ে নিজের মত করেই মানুষ করেছিলেন। যাতে ছেলে কখনও মায়ের কথার অমান্য হতে না পারে। এক কথায় পুরুষ মানুষকে জব্দ করার সব কলা কৌশলই ছিল তাঁর করায়াত্ত।
অজিতেশের মৃত্যুর পর পিতৃহারা দেবদত্তর একমাত্র ভরষা মা পাঞ্চালী তার নিজ কৃতিত্বে ছেলেকে একেবার সম্পূর্ণভাবে নিজের মত করে গড়ে তুলতে লাগলেন। ছেলেও মাকে ছাড়া আর কিছু যে পৃথিবীতে আছে তা জানবার প্রয়োজনও বোধ করল না।
ফলে মার ইচ্ছায় ছেলের শৈশব, কৈশোর কাটার পর যৌবনের সঙ্গীনী পছন্দটাও মার দ্বারাই হতে বাধ্য হল সুপুরুষ, সুশিক্ষিত, সু-চাকুরে দেবদত্তর।
মৌবনী ছেলের বৌ হয়ে এল। এসেই বুঝতে পারল এ বাড়ীতে ছেলের বৌ বাড়ীর মেয়ের ভাগ্যে বাঁচতে পারবে না কোনদিনই। কারণ মেয়েরা এ বাড়ীতে অচ্ছুত।
কিন্তু উপায় নেই। তাই দজ্জাল শ্বাশুড়ীর ছত্রছায়ায় নির্বাক পুত্রবধূর ভূমিকাতেই তার অভিনয় চলতে থাকল সংসারের রঙ্গমঞ্চে।
এরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই মায়ের ইচ্ছায় বংশ রক্ষার তাগিদে একদিন মৌবনী অন্তঃস্বত্ত্বাও হয়ে গেল শ্বাশুড়ীর সাবধানবানী
শুনতে শুনতে – “ বৌমা আমার কিন্তু নাতি চাই, এটা মনে থাকে যেন!”
ভাগ্য বিরূপ মৌবনীর। পুত্র সন্তানের মা হওয়া যেমন তার হয়ে উঠল না তেমন অভাগী পাঞ্চালী তাঁর নাতির মুখ দেখতে পারলেন না। জীবনের এই প্রথম তাঁর পরাজয় হল আর সে পরাজয় একজন নারীর কাছেই। পুরুষের কাছে বীরবিক্রমে জয়লাভ করা পাঞ্চালী হয়ত মনে মনে জানতেন মহিলারাই তাঁকে পরাজিত করতে পারে।
তাই হয়ত তিনি মহিলা বিদ্বেষী চিরটাকাল।
এরপর যা হওয়ার তাই হল।
পাঞ্চালী হার মেনে নিতে পারলেন না।
তিনি তাঁর সুযোগ্য মাতৃভক্ত পুত্রকে নানান ভাবে চাপ দিতে লাগলেন মৌবনী আর তার মেয়েকে পরিত্যাগ করার জন্য।
দেবদত্ত কখনও মায়ের কথার অমান্য হয়নি। তাই সে মৌবনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে লাগল যাতে তার জীবন অতীষ্ট হয়ে ওঠে।
শিশুকালে দুর্ঘটনায় বাবা ও মা-কে হারান মৌবনীর শৈশব কৈশোর আর যৌবন মামার বাড়ীর দজ্জাল মামীর লাঞ্ছনা, গঞ্জনার মধ্যে দিয়েই কেটেছে। ঘটকের আনা সম্বন্ধ পছন্দ হতেই বিয়ের প্রস্তাবে এককথায় মামী রাজী হয়েছিলেন ভাগ্নীকে বিতাড়িত করার ইচ্ছায়।
তাই বিয়ের পর ভাগ্নীর জন্য মামার মন কাঁদলেও মামীর রক্তচক্ষু মৌবনীর সঙ্গে সব রকম সম্পর্কের বাঁধন আলগা করে দিয়েছিল। তারপর একদিন সবার অজান্তেই সেই আলগা বাঁধন খুলে পড়েছিল পারিপার্শ্বিক চাপে।
তাই দেবদত্ত মৌবনীর ওপর মানসিক নির্যাতন করলেও তার আর মামার বাড়ী ফেরার কোন উপায় ছিল না। বাধ্য হয়েই যখন দেবদত্ত তাকে একদিন সন্ধ্যায়
রাস্তায় কুকুরের মত দরজার বাইরে বার কর দিল তখন সে তার মেয়েকে নিয়ে জীবনের নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যেতে বাধ্য হল।
এইসময় মৌবনীর ভাগ্য হঠাৎই সুপ্রসন্ন হল।
রেল ষ্টেশনের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে তার সঙ্গে স্বাক্ষাৎ হল একজন জন হিতৈষী মহিলার। যে মহিলা দুস্থ, আত্মীয়-পরিজনহীন একাকী মহিলাদের নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান নিজেই চালান।
তিনিই মৌবনি আর তার মিয়েকে নিজের কাছে স্থান দিলেন।
সেই মহিলার চেষ্টায় যদিও আইনের দ্বারস্থ হয়ে মৌবনী তার ভাঙ্গা সংসার জোড়া লাগাবার সুযোগ পেল। কিন্তু মৌবনীর ইচ্ছা হলনা তার সেই অতীতে ফিরে যেতে যে অতীতে তার মেয়ের সম্মান নেই।
যে অতীত তাকে পশুর মত তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই মানুষরূপী পশুদের কাছে ফিরে যাবার ইচ্ছে সে মন থেকেই
পরিত্যাগ করল।
তার নতুন ইচ্ছায় সে ঐ প্রতিষ্ঠানে থেকেই সৎ ভাবে নিজের ও মেয়ের জীবনকে রক্ষে করে মেয়েকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করার কঠোর প্রতিজ্ঞাকে জীবন পথে চলার পাথেয় করে অতীতকে ভুলবার চেষ্টা করল।
(৩)
মৌবনীর মেয়ে মৌটুসী। নামটা তার মায়েরই দেওয়া, কারণ মৌটুসী তার বাবাকে চেনে না, তার কাছে তার বাবা নিখোঁজ । তাই সে শুধু তার মায়েরই মেয়ে।
গতকাল প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে মৌটুসী পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে।
আজকের সমস্ত সংবাদপত্রে তার ছবি বেরিয়েছে।
কাগজের লোক তার কাছে এসে স্বাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে।
সকাল থেকে বন্ধুরা ফোনে ফোনে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এন.জি.ও-র মহিলা প্রতিষ্ঠাতা সর্বানী মাসী তাকে মিষ্টী খাইয়েছে, আদর করেছে বুকে জড়িয়ে।
প্রতিষ্ঠানের অন্য সবাই যারা তার আত্মীয়র থেকেও অনেক অনেক বড় তাঁরা সবাই এসে আশীর্ব্বাদ করেছে।
মৌটুসী এই আনন্দ তার মার সঙ্গে ভাগ করতে গিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলেছে।
মেয়ের কান্না মায়ের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে।
আজ মৌবনী জিতেছে। যথাযোগ্য উত্তর দিতে পেরেছে তাদের, যারা মেয়ে বলে একদিন মৌটুসীকে মেনে নিতে পারেনি।
মৌবনীর তাই আজ বড় আনন্দর দিন।
আজ
মনে হচ্ছে এখন একবার যদি দেবদত্ত আসে তার কাছে, তবে সে দেখিয়ে দেবে মেয়েরাও মানুষ। একজন পুরুষের চেয়েও তারা অনেক অনেক শক্তিশালী।
একজন মেয়েও পারে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই আর একটা মেয়ে সন্তানকে সমাজের যোগ্য করে বড় করে তুলতে। আর একটা মেয়ে নিজেকে নিজেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এই পুরুষ শাসিত সমাজে, একজন ছেলের মতই । যদিও দেবদত্ত এখানে কখনও এলে মেয়েকে সে তার বাবাকে চেনাবে না। তার কাছে তার বাবা নিখোঁজ হয়েই থাকবে চিরটাকাল।
-----()------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন