বৃষ্টির জলে জন্ম নেয় তৃণ, চারা গাছ, শ্যাওলা। গোপালের শরীর নিঃসৃত জলে অপেক্ষার দিন গোণে প্রকৃতির নারীত্বের পূর্ণাঙ্গতার।
প্রকৃতি
পার্থ ঘোষ
আবহাওয়া অফিসের ঘোষণা ছিল বিকেলের দিকে ভারী বর্ষণ হবে, সেই সঙ্গে বজ্র বিদ্যুৎ ও প্রবল ঝড়ের সম্ভাবনা। গোপাল আর প্রকৃতির মধ্যেও সেরকমই একটা কথা হয়েছিল। আপেক্ষা ছিল রাত্রির। বুড়োন আকাশের মতি গতি দেখে সে বার্তা অনেক আগেই পেয়েছিল। গাঁয়ের মানুষের এসব খবর জানার জন্য আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা শোনার অপেক্ষা করতে হয় না।বয়সটাও নয় নয় করে কম হল না। সত্তরের কোটায় বিচরণ তার। প্রকৃতির লীলা খেলা বোঝার অভিজ্ঞতা তাই বেশ ভালোই।জীবনের অলস দিন গুলো তার প্রকৃতি দেখেই কাটে। সারদা কখনও তার সঙ্গ দেয়। কখনও কাজের অজুহাত দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকে।
মাঠে কাজ করার জোর এখন আর পায়না সে। জমিগুলো লিজ দিয়ে দিয়েছে বাধ্য হয়েই। অন্য লোকে ফসল ফলায়, বুড়োনকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়। বুড়োন আর সারদার নিজস্ব ফসল তাদের ছেলে গোপাল। সেও এখন চাষ আবাদ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে চাকরী করে। শহরের এক বেসরকারি দপ্তরে। মাহিনা ভালোই পায়। চাষার ছেলের পড়াশুনা শেখার ফল। বাঁধা ডিউটি সেরে বাড়ী ফেরার পর ছয় মাসের নতুন বৌ নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে। শহুরে মেয়ে। ছলাকলা জানে। নামটাও তার শহুরে ধাঁচের – প্রকৃতি।
বৌমা আবার বাচ্ছাদের স্কুলের দিদিমণি। সারা দুপুর তার বাড়ীর বাইরেই কাজ। গোপালের নিজের পছন্দ করা বৌ। সেখানেও বুড়োন আর সারদার কোন ভূমিকা নেই।শহরে শ্বশুড়ের বেশ প্রতিপত্তি আছে। কানাঘুঁষো এরকম খবর ভাসে, গোপালের চাকরীটার পেছনে ওর শ্বশুড়ের কিছুটা অবদান আছে।
তবে চাকরী পেয়ে পুরাতন বাড়ীটাকে বাসযোগ্য করেছে গোপাল। টিনের ঘর ভেঙ্গে পাকা বাড়ী করেছে। বিজলি বাতি এনেছে ঘরে। সুইচ্ টিপলেই আলো জ্বলে। জলের ব্যবস্থা করার জন্যও তদ্বির করছে ইদানীং।তার মধ্যেই প্রকৃতিকে বিয়ে করেছে। রেজিষ্ট্রী ম্যারেজ। ভাব-সাব হয়েছিল অনেকদিন আগেই। শহরে যাতায়াত ছিল গোপালের চাকরী পাবার আগে থেকেই। তার থেকেই কিভাবে আলাপ তার সবটা বুড়োন জানে না।তবে শহুরে হয়ে চাষ-বাস ব্যাপারটা তার মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছে একেবারেই। প্রথম প্রথম বুড়োন ওকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের স্কুল থেকে শুরু করে শহরের কলেজে পড়াশুনা শেষ করা গোপালের মন মাঠের শস্য ক্ষেতের দিকে বিস্তৃত হয় নি। বুড়োন শেষে হাল ছাড়তে বাধ্যই হয়েছে।
বুড়োনের এখন বয়স হয়েছে। শরীরের ক্ষমতা কমেছে। বেশী হাঁটলে হাঁফ ধরে। বুক ধড়্ফড়্ করে। সে আর তাই মাঠের দিকে যায় না। ছেলের পয়সায় তৈরী করা নতুন বারান্দায় বসে বাইরের প্রকৃতি দেখে। আর মনে মনে ভাবে – বাপ বেটা দুজনেই তারা প্রকৃতি প্রমিক। ওর সংসারের বাইরে প্রকৃতি, ঘরেও প্রকৃতি। এ কথা সারদাকে বললে সে বলে – “বুড়ো বয়সের ভীমরতি। বয়স বাড়লে মিন্ষে গুলো এভাবেই জ্বলে ওঠে। ঢঙ্”। বুড়োন সারদার কথায় ‘খ্যাঁক্ খ্যাঁক্’ শব্দ করে হাসে। সারদা বলে – “মরণ”।
বৌমার ঘরের এফ্ এম্ বক্সে কালবৈশাখীর অনুপ্রবেশের ঘোষণায় বিকেলের কথা উল্লেখ থাকলেও, হিসাবের একটু ভুল ধরা পড়লই । ঝড় উঠল, বৃষ্টি নামল, বাজ পড়ল; সবই শুরু হল সন্ধ্যা রাতের কোলে ঢলে পড়ার পর।
প্রথমে ঝড় উঠল। একটা ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শব্দে জানান দিতে থাকল তার বেগকে। আকাশ তখন কালো মেঘের চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। তিনদিনের প্রচণ্ড দাবদাহ আজ যেন গলে গলে পড়তে লাগল ঝড়ের বেগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বৃষ্টির জলের তোড়ে। আকাশ চিরে বিজলির চমকে ক্ষণিকের জন্য তাণ্ডব নৃত্যের ভয়ঙ্কর রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে লাগল। সেই সঙ্গে বজ্রপাতের বুক কাঁপান শব্দ। খুব কাছেই কোথাও পড়ল। কেউ যেন ধারাল ছুরি দিয়ে আকাশকে ফালা ফালা করে কাটছে। তীক্ষ্ণ সাদা আলোর ঝলকে ঝড়ে নুয়ে পড়া বৃষ্টি সিক্ত বৃক্ষরাজি পটে আাঁকা ছবির মত ফুটে উঠতে লাগল কালো আকাশের প্রেক্ষাপটে। প্রকৃতি ক্ষেপেছে।
বুড়োনের চোখে তখন বাইরের রুদ্র প্রকৃতি। গোপাল তখন ঘরের ভেতরের রুদ্রাণী প্রকৃতির রূপে মগ্ন। সেখানে তখন ঝড় চলছে তুমুল ভাবে। বাজ পড়ছে শীৎকারের শব্দে। জল ঝরছে শরীরের গহনে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে চুম্বনের ফলে উৎপন্ন তড়িতে। ঘরে বাইরে তখন উন্মত্ত প্রকৃতি। ঝড়ে নুয়ে যাওয়া গাছের পাতার মত প্রকৃতির কেশরাজি গোপালের মুখ স্পর্শ করছে বন্ধনহীন হয়ে। আজ প্রকৃতিরা ক্ষেপেছে। বাপ বেটায় উপভোগ করছে প্রকৃতিদ্বয়ের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ।
সারদা চুপচাপ ঘরের চৌকাঠে বসে। ছেলের ঘরের বন্ধ দরজা তার ঘরের মুখোমুখি। মায়ের মন সব বোঝে। আশা, যদি নাতি নাতনির মুখ দেখা যায় তাড়াতাড়ি। তবেই তো সংসারের পূর্ণতা। অবসর সময় কাটানর একটা অবলম্বন।
বাজকে বুড়োনের ভয় লাগে। ওর বয়স যখন সাত আট, তখন একবার বাজের আলো চোখে লেগে অঝোরে জল পড়া শুরু হয়েছিল। ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। সেদিন দুপরে খট্খটে রোদের মধ্যে পড়েছিল বাজটা। ওদের বাড়ীর সামনের নারকেল গাছটার মাথার ওপর। তার আলোর ঝলকানি লেগেছিল বুড়োনের চোখে। তারপর সব অন্ধকার। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল অঝোরে জল পড়া । চোখের ভেতরটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছিল। এক চোখ খুলে কোনরকমে সে দেখেছিল সামনের নারকেল গাছটার মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলছে। সেই থেকে একটা চাপা ভয় বাসা বেঁধে আছে তার মনে।
সারদা ভয় পায় শিলাবৃষ্টিতে। দশ এগারো বছর বয়সে একবার চৈত্র মাসের শিলাবৃষ্টিতে শিল কুড়োতে গিয়ে একটা বড় মাপের বরফে মাথা ফেটে গিয়েছিল তার। রক্তে ভরে গিয়েছিল মুখ চোখ । বৃষ্টির জলে রক্ত গুলে পড়ছিল শরীরে। শিলের আকারটা বড়ই ছিল। সেবার গ্রামের অনেকের টালির চালের সঙ্গে মানুষের মাথাও ভেঙ্গেছিল। সেরকম শিলাবৃষ্টি আর কখনও দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ঘটেনি সারদার।
গোপালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোন খারাপ অভিজ্ঞতা নেই ঠিকই। তবে বিয়ের পর থেকে প্রকৃতির নাচন তাকে বেশ বিপর্যস্ত করে। সে প্রকৃতির সঙ্গে পেরে ওঠে না। প্রকৃতি খুব সক্রিয়। কামড়ে, খিম্চে, ক্ষতবিক্ষত করে গোপালকে সেই বিশেষ সময়ে। গোপাল শুনেছে স্ত্রী বেশী সক্রিয় হলে নাকি ছেলে জন্মায়। যদিও গোপালের মেয়েই পছন্দ। তবুও ভগবানের দানে তার কোন আপত্তি নেই। ছেলে মেয়ে যাই হোক সুস্থ হলেই হল।
প্রকৃতি বিশেষ সময়ে অপ্রকৃস্থ হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না। একটা প্রচণ্ড ক্ষিধে। আগ্রাসী ভাব। অতৃপ্তিকে তৃপ্ত করার বাসনা। কাম জোয়ারের উত্তাল তরঙ্গকে বশ করতে না পারার অপারগতা প্রকৃতিকে রুদ্রানী করে তোলে। সেই জোয়ারে ভেসে যায় গোপাল। সুখ পায়, সুখ দেয়। একসময় প্রকৃতি শান্ত হয়।
স্বাভাবিক। শান্ত প্রকৃতির বুকে ঝঞ্ঝাগ্রস্থ প্রকৃতির চিহ্ণ দৃষ্ট হয়। ভাঙ্গা গাছের ডাল, ঘরের ভাঙ্গা চাল। উড়ে আসা গাছের পাতা, গৃহস্থর জামা কাপড়। লণ্ডভণ্ড চরাচর। লণ্ডভণ্ড বিছানা, বালিশ, পোশাক। ভগ্ন বৃক্ষের ন্যায় পড়ে থাকা দুটি শরীর। নিস্তেজ, রসময়, ভিজে, কাহিল, নগ্ন। নগ্নতাই যে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য।বৃষ্টির জলে জন্ম নেয় তৃণ, চারা গাছ, শ্যাওলা। গোপালের শরীর নিঃসৃত জলে অপেক্ষার দিন গোণে প্রকৃতির নারীত্বের পূর্ণাঙ্গতার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন