শিক্ষা
-পার্থ ঘোষ –
(১)
কাল ক্লাবে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান ছিল। আগের দিন সারারাত ধরে ক্লাবের ছেলেরা অতি যত্ন সহকারে পতাকা টাঙিয়েছিল এক বিজলি বাতির স্তম্ভ থেকে আরেক বিজলি বাতির স্তম্ভে দড়ির বন্ধনে। কাল সারাদিন ধরে গান বাজিয়ে, ফুল ছড়িয়ে, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ও বক্তৃতা দিয়ে পালন করা হয়েছিল প্রজাতন্ত্র দিবস। অনুষ্ঠান শেষে বিস্কুট ও লজেন্স বিতরণ করা হয়েছিল, যা সবার সঙ্গে সাদরে গ্রহণ করেছিল ভিখারি ছোটো ছেলেটা। যে ছেলেটা তার লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাড়ার নার্সারি স্কুলটার সামনে প্রতিদিন সকালে বসে থাকে। আর একমনে কচিকাঁচা শিশুগুলোকে দু’চোখ ভরে দেখে। সেইসময় তার চোখের দৃষ্টিতে ঝিলিক দিয়ে যায় উদাস আনন্দ।
(২)
গতকালের অনুষ্ঠান শেষে সবাই ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ গন্তব্যে। ক্লাব প্রাঙ্গণে পড়ে ছিল শুধু বিস্কুট লজেন্সের খালি প্যাকেট আর ছেঁড়া মালা ও ফুলের টুকরো। ক্লাব প্রাঙ্গণের পড়ে ছিল শুধু বিস্কুট লজেন্সের খালি প্যাকেট আর ছেঁড়া মালা ও ফুলের টুকরো। ক্লাব প্রাঙ্গণের ছোট্টো আকাশ ছেয়ে ছিল জাতীয় পতাকার ভীড়ে । তারপর রাত নেমেছিল নির্দিষ্ট সময়ে। মাঝ রাতে উঠেছিল উত্তুরে শীতল হাওয়া। সেই হাওয়ায় ছিঁড়ে পড়েছিল প্লাস্টিক কাগজের তৈরী পতাকার সুতুলী দড়ি। ক্লাব প্রাঙ্গণ, রাস্তায় তখন পতাকার ছড়াছড়ি।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গেছিল ভিখারি ছেলেটার। সে তার মুড়ি দেওয়া নোংরা চাদরের ফাঁক থেকে বিজলী বাতির আলোয় দেখেছিল জাতীয় পতাকার এহেন করুণ অবস্থা। শীত ভুলে দৌড়ে এসেছিল সে। মাঘের শীত তার কৃশ শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। তবু দমে যায় নি সে। কম্পিত ছোটো ছোটো হাতে এক এক করে কুড়িয়ে নিয়েছিল সমস্থ পতাকা। তারপর বুকের কাছে জড়ো করে ধরে এসে বসেছিল তার নির্দিষ্ট জায়গায়।
(৩)
সকাল হয়েছে সময় মত। ব্যস্ত নগরীর মানুষ গতকালের রেশ ভুলে দৈনন্দিন ইুঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে পড়েছে নিত্য নৈমিত্তিক উৎসাহে। নার্সারী স্কুলের হেড দিদিমনি স্কুল খুলতে এসে ভিখারী ছেলেটাকে দেখে বললেন – ‘কিরে? পতাকা গুলোকে ওভাবে ছিঁড়ে ফেলেছিস কেন? তুই তো জানিস না যে জাতীয় পতাকার ওভাবে অবমাননা করতে নেই, দে ওগুলো আমাকে।’ ভিখিরী ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে সযত্নে বুকে ধরা পতাকা গুলো দিদিমনির হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলল – ‘দিদি, ওগুলো কাল রাতে ঝড়ে ছিঁড়ে রাস্থায় পড়েছিল। আমি তুলে এনেছি। আমি জানি আপনি বাচ্ছাদের পড়ানোর সময় বলেন, জাতীয় পতাকা মাটিতে পড়তে নেই। আমি এখানে বসে অনেকদিন সেই কথা শুনেছি। তাই, পতাকার অসম্মান হতে দিইনি, দিদি।
প্রধান দিদিমনি ভিখারি ছেলেটার কথা শুনে চমকে উঠলেন। তাঁর দু’চোখ জলে ভরে এল । তিনি হিতাহিত জ্ঞান ভুলে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন ভিখিরী ছেলেটাকে। তাঁর কান্না ভাজা ধরা গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা শব্দ – ‘বন্দেমাতরম’।
---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন