আবার যদি দেখা হয়- আদিত্য
শেষের থেকেই আবার শুরু করব। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি সব শেষ করেছিলে, ঠিক সেখানেই। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তোমার অপেক্ষায়, তুমি জেগে ছিলে প্রতিদিনের মতো, কিন্তু এলে না। বাড়ির সামনে প্রতিদিনের মতো আবর্জনা পরে, কূটনৈতিক সম্পর্কের তাগিদে হয়ত এখন বাড়িটা ভাগ হয়নি। মনে পরে জয়ী, তুমি আসার পর কিন্তু এই দুই পরিবার এক হয়ে যায়। তারপর দেখতে দেখতে ছটা বছর কেটে গেছে। হাসি-কান্নায় আমরা কাটিয়েছি অনেক দশমী! জয়ী, আমরা লতায়-পাতায় আত্মীয়। এটাই আমাদের পরিচয়।আমি জানি , এর বাইরে আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক সম্ভব নয়। কিন্তু আমি মেনে নিতে পারি না। আমি মেনে নিতে পারি না, তুমি অন্য কারুর কাছে থাক। এটা হিংসা নয়, এটা একটা ভালোবাসা। নামহীন, প্রেমহীন একটা ফ্যাকাসে গল্পের অন্তঃসার।
সালটা ২০১২! একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে প্রথম সেই মেয়েটাকে দেখি। আমি তখন স্কুলে। স্কুল জীবনের সেটাই শেষ বছর। তবে সেই মেয়েটার মধ্যে সেদিন তেমন কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পাইনি। আর পাওয়ারও সুযোগ পাইনি, কারণ সেই মেয়েটা তখন বিয়ের পিড়িতে। সে তখন একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে আর আমি একজন নতুন আত্মীয় পাচ্ছি, ব্যস একটুকুই খুশি ছিল, এই বাইরে কিছু নয়। তবে সেই মেয়েটার মধ্যে সেদিন তেমন কিছু বিশেষত্ব খুঁজে না পেলেও এইটুকু বুঝেছিলাম, এই মেয়েটা বড্ড বাচাল! হ্যাঁ, একদম উড়নচণ্ডী। বিয়ের পিড়িতে বসেও দিব্যি ইয়ার্কি মারছে, হাসছে, ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে। কোনও চিন্তাই তাকে ছুঁতে পারেনি সেদিন, শুধু সেদিন কেন, আজও পারিনি। আজও অসময়ে তার মুখটা মনে পরলে, শুধু হাসতেই দেখি। আর আমিও হাসি এই ভেবে যে, একদিন যার বিয়েতে গিয়েছিলাম সেই মেয়েটা হঠাৎ কীভাবে আমার খেলাঘরের সঙ্গী হয়ে গেছে। হয়ত যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে, যা হচ্ছে সেটাও ভালর জন্যই হচ্ছে।
সালটা ২০১৪। সময়টা ঠিক দুর্গা পুজোর আগে। হঠাৎই একটা ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ঠিক হয়। সঙ্গী বলতে সেই মেয়েটা এবং তার বর। আসলে আমরা তিনজনই আত্মীয়স্বজন । গন্তব্য শান্তিনিকেতন। আমি তখন কলেজ ছেড়ে দিয়ে কবিতা লেখায় মন দিয়েছি। পাশাপাশি থিয়েটারটা চলছে সঙ্গে ম্যাগাজিনের সম্পাদনার কাজ করছি। যদিও সেই আধুনিক মেয়েটা আমার সামনে যতই আমার প্রশংসা করুক না কেন, পিছনে পিছনে এই ব্যাপারটাকে নিয়ে যে সে হাসত সেটা আমি জানি! আসলে সে কোনওদিনই শিল্পীকে বোঝেনি, হয়ত আজও নয়। কলেজ ছেড়ে দিয়ে একটা তরুণ যুবক এই সমস্ত আঁতলামি করছে, লেঙ্গি খেয়ে কবিতা লিখছে এইসব তার একেবারেই অপছন্দ ছিল। আমার এখন মনে আছে সেই প্রথম আমরা তিনজন একসঙ্গে মদ খেয়েছিলাম। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। যদিও সেই মেয়েটা আমাকে বারবার সাবধান করেছিল, ‘ বেশি মদ খাস না! বমি করলে কিন্তু আমি পরিষ্কার করব না।‘ কিন্তু আমি সেদিন নেশায় হারিয়ে গিয়েছিলাম, বমিও করেছিলাম এবং সেই মেয়েটাই বমি পরিষ্কার করেছিল! তখনও কিন্তু আমাদের প্রেমটা শুরু হয়নি, তখনও আমরা আত্মীয়স্বজন।
সালটা ২০১৪। একবারে বছরের শেষের দিকে আমি হঠাৎ সেই আত্মীয়স্বজনের ডাকে মুম্বই গিয়েছিলাম। প্রায় দিন দশ-বারোর জন্য। তখনও আমি কলেজ ফেরত এক কবি, এক লেঙ্গি খাওয়া প্রেমিক! যদিও তখন নাট্যমঞ্চে বেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, তবে সেসবই আমার নাট্যগুরুর দয়ার দান। সেই মেয়েটা তখন বেশ পরিণত। আগের মতই উজ্জ্বল এবং মিশুকে। কোনওদিন তাকে রাগতে দেখিনি। এখনও মনে আছে, সেই দিনগুলো কেমন ভাবে কেটে গিয়েছিল। সেই মেয়েটা বারবার চাইত আমাকে পজিটিভ করতে, আমাকে ভাল রাখতে। আদর, আপ্যায়নে কোনওদিনই তার কোনও খামতি ছিল না। তবে রান্না করার ব্যাপারে সে চিরকালই একটু ‘লেটুস’। আমিও কোনও কোনও দিন তার সহকারী হিসেবে কাজ করতাম, তবে বিনা পারিশ্রমিকে নয়। সে আমাকে সারাদিন বিভিন্ন গল্প কথায় ভুলিয়ে রাখত। সারা মুম্বই আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুরে বেড়াত। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে বেশ অধ্যাপকদের মতো খবর শোনাত। আবার ব্যাডমিন্টনও খেলত। সুযোগ পেলে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দৌড় দিত। রাত নামলে আমরা তিনজন একসঙ্গে বসে মদও খেতাম। অনেক গল্প হত। কিন্তু তখন সেই মেয়েটার মধ্যে কোনও বিশেষত্ব খুঁজে পাইনি। সেই মেয়েটা তখনও শুধু সেই মেয়েই ছিল, এর বেশি কিছু নয় ।
তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমি একটু পরিণত হয়েছি। আবার কলেজ জীবন শুরু করেছি। সঙ্গে লেখালেখি, সম্পাদনা এবং অভিনয় চলছে। সদ্য আটপৌরে শুরু করেছি- একটা ওয়েব প্ল্যাটফর্ম! ততদিনে সেই মেয়েটা মা হয়েছে। আরও পরিণত হয়েছে। আরও উজ্জ্বল হয়েছে। তবে সেই মেয়েটার সঙ্গে আমার একমাত্র পুজোর সময়ই দেখা হত। এছাড়া সে বিশেষ একটা যোগাযোগ রাখত না। হয়ত এটাই তার স্বভাব। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু পাল্টে গেল। ২০১৬ সালে সেই মেয়েটা মা হল। তারপর বেশ কিছুদিনের জন্য সে এই প্রাচীন বাড়িতে ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে হঠাৎই সেই টানটা উবে গিয়েছিল। ঠিক কী কারণে সেটা জানি না। তবে সে তখনও হাসিখুশি ছিল। তারপর আমিও ব্যস্ত হয়ে পরলাম। যোগাযোগ প্রায় ছিলই না, তবে যখনই যোগাযোগ হত, তখনই বড্ড জ্ঞান দিত, ঠিক অধ্যাপকের মতো!
এরপর ২০১৭! সময়টা মহালয়া। প্রতিবারের মতো এইবারেও সেই মেয়েটা এল কিন্তু আর ফিরল না। আর সে আমার আত্মীয় রইল না। সেই মেয়েটা জয়ী হয়ে গেল আমার কাছে সারাজীবনের জন্য! সেই মেয়েটা যার কোনও বিশেষত্ব খুঁজে পাইনি সেইদিন,তার কিন্তু প্রচুর বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম জয়ী হওয়ার পর।
সব প্রিয়জনই কিন্তু প্রয়োজন হয়, কিন্তু সব প্রয়োজন প্রিয়জন হয় না! জয়ী, তুমি রূপকথার গল্প হলেও হয়ত সময়টা থমকে থাকত না। আমায় বারেবারে উদাসী করত না কোনও শান্ত বিকেল। ঝরা বসন্তের প্রমাদ গোনা কোনও পাগল বালকও, তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেত না সারাদিন! জয়ী, তুমি কেন এসেছিলে ? হয়ত তুমি না আসলে আজ সময়টা অন্য হত। আমিও হয়ত আজ অনেকটা সুস্থ থাকতাম। আমিও আজ অন্য কাউকে নিয়ে কাব্য করতাম। কিন্তু তুমি সব ভুলিয়ে দিয়ে গেছো। এই শহরটাকে আবার হারতে শিখিয়ে গেছো। এখন বুকের ভিতরটা কেমন করে, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না!
জানো জয়ী, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আদেও ভালবাসা ছিল নাকি সবটায় নাটক। আমি চিরকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম, কিন্তু তুমি কোনদিনই আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকনি। আমি সময় খুঁজে নিতাম আর তুমি অজুহাত! জয়ী, তুমি আমার প্রেমিকা হলে আজ তোমায় নিয়ে হয়ত অন্য কথা বলতাম। আজ তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে, উপন্যাসটা অন্য হত। কিন্তু তুমি আমার আত্মীয়। তুমি আমার আপনজন। বড্ড আদরের।
হয়ত এগুলো সবই আমারই। তুমি আমায় কোনদিন ভালবাসতে চাওনি। এড়িয়ে গেছ। আমাকে বারবার আটকে দিয়েছ। কোনওদিন স্বীকার করোনি মিথ্যেগুলো। বিবাহিত জীবনে প্রেম আসতে পারে জয়ী, কাউকে ভালবাসতে গেলে অন্য কেউ ঠকে যায় না। আমি তো সব কিছু জেনেও এগিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম, যেখানেই থাকি নিজেদের খুব কাছে থাকব। হয়ত আমিই শুধু সেই কথাগুলো রেখেছি, তুমি সেগুলোকে ঘুড়ি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছ। তুমি আমার সবটা জানো। তাই আমাকে শাসন করতে পারো। আমাকে নিয়ে মজা করতে পারো। আমি তো শুধু তোমাকে ভালবাসতে জানি, তাই শ্রদ্ধা করি।
আমাকে পাগল করে সাজিয়ে রেখেছ তোমার ড্রয়িং রুমে। তাই এই সম্পর্কটা এতটা সহজ হয়ে গেছে। তোমার ক্ষমতা আছে, আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কিন্তু আমার নেই! এত কিছু শিখিয়েছ, শুধু এইটাই শেখালে না! তাহলে আজ এতটা কষ্ট পেতে হত না।
আমি জানি না, তুমি কেন চাও আমি তো তোমাকে ভুলে যায় । কেন চাও আমি তোমার থেকে দূরে থাকি। জয়ী, জীবনটা এতটা সহজ নয়। এত সহজে কাউকে ভোলা যায় না। তুমি যে প্র্যাক্টিকাল হওয়ার কথা বল, সেটা আসলে বস্তাপচা কনসেপ্ট। তুমি জানোই না, আবেগ আর প্র্যাক্টিকাল এর পার্থক্যটা কোথায়!
তবে একদিন আমাকে খুঁজতে আসবে। আমাদের সময়টাকে আবার জাপটে ধরতে ইচ্ছে করবে। চুমু খেতে ইচ্ছে করবে বয়সের ছাপ পরা গালে! ‘এভরিওয়ান হ্যাভ এ স্টোরি ‘ ছেড়ে আমাদের গল্পটা পড়তে ইচ্ছে করবে। আসলে প্রত্যেকটা গল্পই খুবই রোমাঞ্চকর। শুধু কে পড়ছে, তারওপর নির্ভর করে! তোমায় হয়ত মিথ্যে বলেছিলাম, দুবার! কিন্তু তুমি আমায় পুরোটায় অন্ধকারে রেখে দিয়ে চলে গেছো।
জানো জয়ী, এখন দিনগুলো বাজে গেলে মনে হয়, তুমি এই এসে
বলবে,” সব ভাল হবে “ , এখন একটা অবোধ শিশুর মতো তোমার
জন্য অপেক্ষা করি। জয়ী, মাঝে মাঝে ভাবতাম, তুমি যদি চলে
যাও তাহলেও তোমার কিছু এসে যায় না। কারণ তোমার একটা সংসার আছে, একটা গল্পের মতো
জীবন আছে। উল্টো দিকে আমার কাছে কিছুই নেই।
ভয় পেতাম, যদিও এখন পায়। না, তোমাকে হারানোর
ভয় না। আমাদের সম্পর্কের ভয়। চিরকালই আমরা সাস্পেক্ট ছিলাম, আছি এবং
থাকব।
জয়ী, তুমি যেখানেই দাঁড়াবে, সময়টা শুধু তোমাকেই খুঁজবে। সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে, অভ্যাসটাও পাল্টে ফেলেছি। এখন
তোমার রোদ ভেজা শহর অন্য গল্পের খোঁজে হাহুতাশ করছে। মুম্বই আর কলকাতার সম্পর্কটা
অনেক পুরোনো। ওটা সহজে ভাঙবে না জয়ী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন