নেশার ঘোরে এলোপাথাড়ি প্রহার করে যখন সাড়হীন শরীরটাকে বিছানায় নিক্ষেপ করে, তখন মানুষটাকে কেমন শিশুর মত লাগে।
বিষ মদ
-
পার্থ ঘোষ –
রিক্সাচালকের সংসারে অভাব অনটন নিত্যকার
ঘটনা। যেমন সকালের কর্মঠ মানুষটার রাতের অন্ধকারে বদলে যাবার ব্যাপারটাও
দৈনন্দিনের। পারুলের এসব সহ্য হয়ে গেছে। সবাই যে এমন তা নয়। কিন্তু নকুল এরকমই ।
সংসার জীবনের প্রথমে অবশ্য এরকম ছিল না। কবে থেকে যে এসব শুরু হল ঠিক খেয়াল হয় না।
সকালে কত সোহাগ – পারুল তোর শরীরটা খারাপ
হয়ে যাচ্ছে। একা একা তোর দিন কত কষ্টে কাটে আমি বুঝি রে। কি আর হবে বল, ওপরওয়ালা
যদি তোর কোলটা ভরে দিত, তাহলেও.....। আমার সঙ্গে তোর জীবনটা জুড়ে গিয়ে তোর সব শেষ
হয়ে গেল – কত কথা। রাত হলেই পাল্টে যায় কথার ভাষা – এই শালী, মারব মুখে লাথি, গতরে
কি বাত ধরেছে? নাকি নতুন ভাতার আদর করেছে? ........মাগী দেখছিস না আমি ঘরে এসেছি?
চুপ করে বসে আছিস যে?- সূর্য আর চাঁদের মধ্যে যে তফাৎ, সকালের নকুল আর রাতের
নকুলের মধ্যে একই তফাৎ দেখে পারুল।
প্রথম প্রথম রাগ হত। লজ্জা পেত। মনে হত
পালিয়ে যায়। কিন্তু মানুষটাকে যে বড় অসহায় লাগে রাতের বেলা। নেশার ঘোরে এলোপাথাড়ি
প্রহার করে যখন সাড়হীন শরীরটাকে বিছানায় নিক্ষেপ করে, তখন মানুষটাকে কেমন শিশুর মত
লাগে। মায়া হয়। প্রহারের বেদনা মাখা শরীরটা শত কষ্টেও পারুলের মনটাকে বেদনাময় করতে
পারে না। পারে না মানুষটাকে দূরে সরিয়ে দিতে।
নকুলের মনে অনেক কষ্ট। পারুল জানে। সে মেয়ে। সন্তানহীনতার কষ্ট মুখ
বুঁজে সহ্য করে। নকুল পারে না। পুরুষ জাতটা যে বড় সুখী। মদ মানুষটাকে খেয়েছে। অনেক
চেষ্টা করেও নকুলের মদ খাওয়া বন্ধ করতে পারে নি পারুল।
মার খেতে খেতে এখন সহ্য হয়ে গেছে পারুলের। সারা
গায়ে কালশিটে দাগ। একটা মিলিয়ে যায় তো আর একটা হয়। সকালের আলোয় যখন সেই কালো কালো
বেদনা মাখা দাগ গুলোর ওপর নকুলের আলতো হাতের ছোঁয়া পড়ে, তখন পারুল অভিমানে ঠোঁট
ফোলায়। মুখে বলে – যাও! আদর করে কি হবে? আবার তো রাতে মারবে, আবার ব্যাথা হবে।
আবার দাগ হবে।নকুলের মুখটা তখন কেমন করুন লাগে পারুলের।
মনে হয় এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। অস্ফুটে শুধু বলে – আর খাব না, দেখিস। ছেড়ে দেব,
ক’দিন সময় দে। ঠিক ছেড়ে দেব।
পারুল জানে নকুল কোনদিনই মদ ছাড়তে পারবে না।
ওগুলো তার কথার কথা। রাত হলেই ভুলে যাবে। এ এক অদ্ভুত সংগ্রাম, বেঁচে থাকার।
পারুল জানে মানুষটার মনে একটা দুখঃ আছে। একে
ত অভাবের সংসার তার ওপর বাচ্চা-কাচ্চা হল না। পুরুষ মানুষ কত আর সহ্য করবে? যদিও
বাচ্চা না হওয়াটার জন্য পারুলের দোষ আছে। যদিও সেটাকে ঠিক দোষ বলা যায় কিনা জানে
না পারুল।
দোষ বলতে যা বোঝায় সেটা কিন্তু পারুল করেনি।
ভাগ্য, তাছাড়া আর কি? হ্যাঁ, এর জন্য ভাগ্যকেই দায়ী করা যায় বটে। মানুষটা জানে সবই। ওই মানুষটার জন্যই তো এখনও
নিশ্বাস নিতে পারছে, বেঁচে আছে।
দোষ যেটা হয়েছিল পারুলের সেটা হল মানুষকে
বিশ্বাস করা। অসিতদাকে বিশ্বাস করেছিল সে। ভুল করেছিল। অভাবের ঘরে একটা চাকরীর আশা
জীবনকে চাঙ্গা করে। সেই লোভের জন্যই আজ পারুল বাঁজা।
সত্যই পারুলের মা হওয়া হবে না কোনদিন। নকুল
কোনদিন বাবা হতে পারবে না। সেই চিন্তাটাই মনে হয় কুরে কুরে খায় তাকে। আর তখনই হয়ত
সে ওরকম মারমুখী হয়ে ওঠে।
বিয়ের পর কিন্তু নকুল এরকম মদ খেত না। মানুষটা ভালোই ছিল। যত দিন যেতে থাকল ততই যেন কিরকম হয়ে উঠতে লাগল। পারুল এই একটা জায়গাতেই নিজেকে ক্ষমা
করতে পারে না। ভাবে তার সঙ্গে যদি নকুলের দেখা না হত, তাহলে ওদের বিয়েটাও হত না।
এরকম ভাবে জীবনটাও নষ্ট হত না নকুলের। মনে পড়লেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।
ওদের টালি ছাওয়া ছোট্ট টিনের ঘরটার বাতাস
গুমড়ে ওঠে মাঝেমাঝেই। বিশেষতঃ যখন পারুল ঘরে
একা থাকে তখন। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ওঠে, মনে
হয় ঘরটা তাকে গিলতে আসছে। দেওয়ালের গায়ে
ঝুলে থাকা টিকটিকিটা যেন তার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। পারুল দু’হাতে মুখ ঢাকে।
কখনও সে একাকী ঘরে তার ছোট্টো আয়নাটায় নারী অঙ্গের প্রতিচ্ছবি দেখে পোশাকের আড়ালকে
দূরে সরিয়ে দিয়ে। কি কাজে লাগল? কাজ শুরু হবার আগেই যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেল। চোখ ফেটে
জল আসে।
তারা তো এখনও বেঁচে। ক্ষতি তো এখনও কিছুই
হয়নি তাদের। হয়ত হবেও না। যত কিছু হারাল
পারুলেরই। ডাক্তারের গম্ভীর স্বর এখনও কানে বাজে। ভুলতে পারে না সে। যেমন ভুলতে পারে
না সরস্বতী পূজোর সেই রাতের কথা। ভুল ভুল ভুল। সীমাহীন ভুল। পাহাড়ের ওপর পদস্খলের
মত ভুল। খাদের স্বাদ, খাদের গভীরতা, খাদের ভয়াবহতা, অতল খাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন
প্রেক্ষাপট, আর অন্ধকারময় জীবনের সর্পিল পিচ্ছিল রাস্তা।
জীবনকে বাজী রেখেছিল পারুল। জীবন-বাজী। ভালো
কাজের আশায় অসিত আর তার বন্ধুদের লোলুপতার
শিকার হয়ে জীবনকে হারিয়েছে সে। কোলকাতায় চাকরী; অনেক মাহিনা, সব ভাঁওতা। শিকার
ধরার ফাঁদ। বোঝেনি সেদিন কিশোরী পারুল। তার ওপর ছিল ভালোবাসার লোভ। প্রেমের স্বাদ,
বিয়ে, সংসার, স্বামী, সন্তান, পুরুষের বক্ষলগ্না হওয়ার দুর্নিবার আকর্ষণ, অল্প
বয়সের কাঁচা মনকে খুন করেছিল।
অসিত সরস্বতী পূজোর রাতে পূর্বকল্পিত ছকে
পারুলকে এঁটো করেছিল। পরদিন পারুলের শহরে কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। অসিতই ভোরের
ট্রেনে নিয়ে যাবে বলেছিল। এও বলেছিল – কাল তো চলেই যাবি, আজ একটু আদর কর।
আদর করেছিল পারুল। আদর করেছিল অসিতও। তখনও তো
জানত না যে অসিতের আদর শেষ হলে তার বন্ধুরাও তাকে আদর করবে। ঘটেছিল তাই। পূজো
প্যাণ্ডেলের আড়ালে পুকুর ধারে ওরা মোট ছয়জন একে একে পারুলের নরম স্পর্শকাতর নারী
অঙ্গগুলোকে নিষ্পেষিত করেছিল। রক্তাক্ত করেছিল। ছিন্নভিন্ন করেছিল শরীরের গোপন
অঙ্গের পেশী, শিরা-উপশিরা গুলোকে।
রক্তাক্ত, জ্ঞান হীন শরীরটা লুটিয়ে পড়েছিল
কাদায়। নিষ্পাপ মনটা থেকে স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে গিয়েছিল। তবু মরেনি পারুল। বেঁচে গেছে। অসিতরা পালিয়ে ছিল গ্রাম থেকে।
মদের ঘোরে ওরা বুঝতে পারেনি সুখের শেষটা এরকম হবে। অনেকদিন ওদের আর গ্রামে দেখা
যায়নি। যদিও পারুল ও কারো কাছে ওদের নাম করতে পারে নি। পুলিশের কাছেও না। বলেছিল,
রাতের অন্ধকারে ওদের চিনতে পারেনি। ভয় ছিল, ওরা যদি ভাইটাকে কিংবা ছোট বোনটাকে
কিছু করে দেয়! তাই মুখ বন্ধ করে ছিল।
নকুলকেও জানায়নি।
সেদিন ভোর রাতে রিক্সা নিয়ে যেতে গিয়ে নকুলই
ওকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে লোক যোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক কিছু
হয়েছিল। যা যা হয়ে থাকে। এমনকি একটা ধর্ষিতা মেয়েকে যেভাবে লোকে দেখে থাকে। জুলজুল
করে, যেন চাইলেই পাওয়া যায়, কিংবা দেখলেই মনে পড়ে যায় – উলঙ্গ, যন্ত্রনা কাতর
চোখের সামনে ফুটে ওঠা সেই ছবি; অথবা সেই সব প্রশ্নবাণ – কিভাবে হল? কারা করল?
ইত্যাদি...ইত্যাদি...
তবে নকুল দয়া করে নয়, মানুষ হিসাবে,
ভালোবাসার খাতিরে, বিয়ে করে ফেলেছিল পারুলকে। পারুল প্রথমে রাজী হয়নি। কিন্তু
নকুলের জেদের কাছে মাথা নত করতে হয়েছিল। পারুল বলেছিল – আমি নষ্ট হয়ে গেছি। নকুল
বলেছিল – তুই কি বাজারের আনাজ? যে নষ্ট হয়ে যাবি? পারুল বলেছিল – লোকে তোকে নিন্দা
করবে। নকুল বলেছিল – লোকেই তোর জীবনটাকে নিয়ে খেলা করেছে, তাদের নিন্দা করার
অধিকার নেই।
সত্যিই পারুল নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তারের
ভাষায় ওর ক্ষতিগ্রস্থ নারী অঙ্গ কোনদিন সন্তান উৎপাদন করতে পারবে না। অনেকদিন
হসপিটালে থাকার পর একদিন পারুলকে নকুল বাড়ী এনে তুলেছিল। একরোখা, বদরাগী নকুলের
সাতকূলে কেউ নেই। গ্রামের মানুষ তাকে খুব একটা রাগাতেও চায় না। কম বয়সে জ্যান্ত
কুকুরকে আছড়ে মাড়ার কথা লোকে জানে। কুকুরটার দোষ ছিল সবাইকে তাড়া করত, কামড়াত।
রাতের অন্ধকারে চোর ধরে তার হাত দুটোকে ভেঙ্গে দেবার মত কাজের সাক্ষীও আছে
গ্রামবাসী। আবার সেই নকুলকে গ্রামের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতেও দেখেছে সবাই।
সেসব অনেকদিনের কথা। মাঝে মাঝে মনে পড়ে। নকুলের
জন্যই মনে পড়ে পারুলের। নকুল পাল্টে গেছে। কেন এরকম হল, তার কারণ জানা যায় না।
নকুল বলে না। সকালে যখন নেশা কেটে যায় তখনও
না। একটা সন্দেহ যে জাগে না পারুলের মনে
তা নয়, নকুল কি অসিতদের কথা জানতে পেরেছে? মনে হলেই বুক কাঁপে তার।
নকুল ছাড়া তার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বাবা মা সম্পর্ক রাখে না। ভাই বোন থেকেও নেই।
সবাই তার দোষ ধরে। সেই নকুল যদি রাগের মাথায় কিছু করে বসে, তাহলে.... তার কি হবে?
পারুলের পা কেঁপে ওঠে।
কম্পনটা বাড়তে থাকে পারুলের। বাড়তে শুরু করার
কারণ অসিত আর নকুল। ওরা এখন একসঙ্গে মদ খেতে যায় শুঁড়িখানায়। খবরটা কানে আসে
পারুলের। অঘটন যখন তখন ঘটতে পারে। মদের
ঘোরে অসিত যদি বলে ফেলে সেদিনের ঘটনা, কিংবা নকুল যদি সব জেনে না জানার ভান করে
অসিতের পেট থেকে সব কথা বার করে নেশার ঘোরে, তাহলে...... আর ভাবতে পারে না পারুল।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে তার বন্ধু আয়নার সামনে।
অনেকদিন পর নকুলের মদ
না খেয়ে রাতে বাড়ীতে আসা পারুলকে আনন্দ দেয়, সেই সঙ্গে তাকে ভাবায়। পরদিন সকালে
অসিত আর তার বন্ধুদের বিষমদে মৃত্যুর খবর ছড়ায় লোক মুখে। পারুল সকালের রৌদ্রালোকে
ভালো করে নকুলের মুখের দিকে তাকায়; জিজ্ঞেস করে – তুই কাল মদ খাসনি? ওরা খেল আর
তুই খেলি না? একসঙ্গেই তো প্রতিদিন শুড়িখানায় যেতিস। নকুল বলল – শুঁড়িখানায় গেলেই
কি মদ খেতে হবে? আর তাছাড়া রাখে হরি মারে কে? পারুলকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে
নকুল বলে – দেখছিস কি? কুকুর পাগলা হয়ে গেলে কেউ না কেউ তাকে মারবেই, সে মানুষই
হোক বা ভগবান, কিংবা ভূত।
পারুলের মনে হল
ভূমিকম্প হচ্ছে।
---------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন