বছর দশেক পর
আদিত্য ঘোষ
শেষ পর্ব
(৯)
‘’
মনে পরে, তুমি এই ছাদে দাঁড়িয়েই সব শেষ করে চলে গেছিলে!’’
‘’
হুম। তোর ভালর জন্য।‘’
‘’
আমার ভাল চাইলে তুমি কোনওদিনই আমাকে এইভাবে এড়িয়ে যেতে না।‘’
‘’
পাগল! তুই একটা মস্ত পাগল।‘’
‘’
তুমি কোনওদিনই আমাকে বোঝোনি।‘’
‘’
সেই রে, তোকে না বুঝলে কোনওদিনই তোকে এড়িয়ে যেতে পারতাম না।‘’
‘’
মানে? ‘’ আমি আবাক হয়ে জয়ীর দিকে তাকালাম।
‘’
জানিস, জীবনে এমনভাবে কাউকে কোনওদিন এড়িয়ে যাইনি, যে ভাবে তোকে এড়িয়ে গেছি।‘’
‘’
কিন্তু কেন? ‘’
‘’
তোকে ভালবাসতাম তাই, তোকে কোনওদিন হারাতে চাইনি। সেই জন্যই তো তোর থেকে দূরে চলে
যেতাম।‘’
‘’
দূরে গিয়ে কাউকে ভালবাসা যায়?’’
‘’
আরও বেশি যায়।‘’
‘’
তোমার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।‘’
‘’
তুই এখনও বাচ্ছা আছিস।‘’
জয়ীর
মুখে সেই হাসিটা আবার দেখতে পেলাম। সেই উচ্ছ্বাস, যেটা দেখে আমি ওর প্রেমে পাগল
হয়ে গেছিলাম। আমি জয়ীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘’
তুমি কী বলতে চাইছ, সেটা স্পষ্ট করে বল তো। এত হেঁয়ালি ভাল লাগছে না।‘’
‘’
আমি তোর কাছে থাকলে, তুই আজ এত বড় লেখক হতে পারতিস ?
‘’
হ্যাঁ, আলবাত পারতাম।‘’
‘’
তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু পারতিস।‘’
‘’
জয়ী, তুমি ছিলে বলেই হয়ত...’’
জয়ী
কথাটা শেষ করতে দিল না। আমাকে থামিয়ে বলল,
‘’ আমরা জানতাম, আমাদের সম্পর্কের কোনও পরিণতি নেই, কিন্তু তাও আমরা একে অন্যকে
ভালবেসেছি। এর চেয়ে বড়ো পাওনা কিছু হতেই পারে না।‘’
‘’
সেই সময় আমার বয়সে এতকিছু মাথায় আসেনি। তুমি অনেকটা পরিণত ছিলে। শুধু জানতাম আমাদের
যোগাযোগটা থেকে যাবে। এই বিশ্বাসটা ছিল। কিন্তু তুমি সেটাও...’’
‘’
জানিস সেদিন তোর বিশ্বাস কেন ভেঙেছিলাম?’’
আমার
সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। যে উত্তরটা পাওয়ার জন্য শেষ দশ বছর মুখবুঝে
অপেক্ষা করেছি। ইচ্ছে হলেও জয়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। রাতের পর রাত নেশা করে
কাটিয়েছি, আজ সেই উত্তর পাওয়ার দিন। আমি বললাম, ‘’ কেন জয়ী, কেন আমাকে এড়িয়ে যেতে
?’’
(১০)
মণ্ডপে তখন একটা টিমটিমে
প্রদীপ জ্বলছে। দশমীর সিঁদুর খেলাও শেষ। শেষ ভ্যানটাও চলে গেল। যতদূর দেখা যায়,
শুধুমাত্র ঢাকিদের মাথা সঙ্গে একদল মাতালদের নাচ। একেবারে শেষের দিকে মহিলারা খুব
সংযত হয়ে হেঁটে চলেছে। ধীরে ধীরে আলোগুলো
ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজও
মিলিয়ে যাচ্ছে অদূরে। জীবন থেকে আরও একটা দুর্গা পুজো উধাও হচ্ছে। অন্ধকার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার অন্ধকার
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছি আর ভাবছি, ‘বেকারদের কীইবা নবমী আর কীইবা
দশমী। সবই তো এক। সবই তো ছুটির দিন। প্রত্যেক দিনই তো মদ খেয়ে মাতাল হওয়া যায়।’
একটা
উদাসী মন নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি। গলির লাইটগুলো খুলে নিয়েছে চলে গেছে। প্রতিদিনের
মতো একদল সারমেয় গা এলিয়ে পড়ে আছে। পুকুরের ধারে কিছু অবাঙালী ছেলে মদের আসর নিয়ে বসেছে।
আবার সেই প্রতিদিনের মতো একটা বিদঘুটে অন্ধকার ছায়া ফেলছে জীবনে।
পুকুর
পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে
চোখে পড়ল দোতলার জানলাটা খোলা। আগে পুকুর পাড় থেকে আমাদের বাড়িটা দেখা যেত না,
কিন্তু এখন আমাদের বাড়ির সামনের পোড়ো বাড়িটা ভেঙে দেওয়ার পর,পুকুর পাড় থেকে আমাদের
দোতলাটা দেখা যায়।
দোতলার
ঘরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, জয়ী একটা বই হাতে বসে আছে। এখন মুখে সিঁদুর লেগে।
গায়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি। একেবারের জন্যও আমার দিকে ফিরে তাকাল না। আমি মনে মনে
ভাবছি, ‘’ কী এমন পড়ছে, যার জন্য এখনও
শাড়ি পাল্টায়নি, মুখ ধোয়নি, সিঁদুর পরিষ্কার করেনি।‘’ তারপর মনে হল নিজের চরকায়
তেল দিই, প্রবাসী বাঙালীরা একটু লোকদেখানি হয়!
জয়ী
তখনও আমার শুধুমাত্র আত্মীয়। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বাড়িতে এসে যথারীতি বড়দের
প্রণাম করে একমনে বসে নাটকের স্ক্রিপ্টটা পড়ছি। অনেকটা সময় কেটে গেছে। হঠাৎ
জয়ী এলো। হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি। ঘরে আমি একাই ছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে একটা মজার
ভঙ্গিতে বলল, ‘’ কি রে আমাকে প্রণাম করবি না? তোর চেয়ে আমি প্রায় দশ বছরের বড়
হয়।‘’ আমি একটু মজা করে বললাম, ‘’ প্রণাম করলেই কি ভাল আর না করলে বাজে ?’’ জয়ী
মুখটা বেঁকিয়ে বলল, ‘’ যা, করতে হবে না! কাকু-কাকিমা কোথায়?’’ ‘’ ওপরের ঘরে
আছে,যাও।‘’ জয়ী যাওয়ার সময় মুখটা ভেঙিয়ে চলে গেলে।
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/02/blog-post.html ( প্রথম পর্ব)
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/02/blog-post.html ( প্রথম পর্ব)
মেয়েটা
বরাবরই হাসি-খুশি। প্রায় ছয় বছর ধরে ওকে দেখছি। কখন কারুর ওপর ওকে রাগ করতে
দেখিনি। সবসময় চনমনে। এমনকি ওর বিয়েতে পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানেও ওকে হাসতে
দেখিছি, খুনসুটি করতে দেখছি। কিন্তু ওদের বিয়েটা অ্যারেঞ করে হয়েছে। জয়ীকে অনেকবার
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘’ তুমি প্রেম করোনি ?’’ জয়ী বলত, ‘’ হ্যাঁ! তবে সেইরকম না।
ওটাকে প্রেম বলা যাবে না।‘’ যদিও আমার বিশ্বাস হত না। মনে হত জয়ী এড়িয়ে যেতে
চাইছে। তবে ওকে অবিশ্বাস করতেও সাহস হত না।
মেয়েটাকে
বারবরই দেখেছি বরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। কোনওদিন ঝগড়া করতে দেখিনি। আমি বছর
চারেক আগে জয়ীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেটাও আত্মীয়তার টানে। তখন শুধু ওদের মধ্যে
প্রেমই দেখেছি। শুধু তাই নয় ওদের সঙ্গে বসে মদও খেয়েছি। ওরা বারাবরই বড্ড মিশুকে।
তবে জয়ীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দিনে দিনে আরও বেশি আপন হয়ে যাচ্ছিল। কবিতা, নাটক,
গান আমাদের আরও কাছে টানছিল। আর আরও বেশি করে টানছিল জয়ীর ব্যবহার। প্রতেকবার এই
পুজোর সময় জয়ী আসে আর পুজো শেষ হলে চলেও যাও। কিন্তু এইবারে জয়ী এই বাড়িতে প্রায়
তিন মাস থাকবে। সঙ্গে থাকবে জয়ীর দেড় বছরের মেয়ে। হয়ত
ওর জন্যই আমাদের সম্পর্কটা এতটা সিক্ত হয়েছিল।
আমি তখন একটা চাকরির জন্য ছটফট করছি। বহু
পত্রিকার দপ্তরে আমার ‘সিভি’টা তখন চপ-মুড়ি খাওয়ার জন্য হয়ত ব্যবহার হচ্ছে। এইদিকে
আমার কলেজ লাইফও প্রায় শেষের পথে। নাটক প্রায় বন্ধ বললেই চলে। তেমন কিছু লেখাও আসছে
না।
জয়ীর প্রতি আসলে চিরকালই দুর্বল ছিলাম, কিন্তু
কোনওদিন প্রেমের অনুভূতিটা আসেনি। আমরা একসঙ্গে মুম্বই ঘুরেছি, শান্তিনিকেতনেও ছুটে
বেরিয়েছি, মদও খেয়েছি কিন্তু জয়ী আমার কাছে অভিভাবকের মতোই ছিল।
অক্টোবর মাসটা প্রায় শেষ। জয়ী বাড়িতে এসেছে
প্রায় দিন পনেরো অতিক্রান্ত। কিন্তু তখনও আমরা শুধুমাত্র আত্মীয়। একদিন বিকেলে আমাদের
দালানে দু’জন দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছি। গল্প করছি,
‘’ তুমি কিন্তু মোটা হয়ে যাচ্ছ!’’
‘’ জানি। আমার ভাইও বলছিল। তাই আমি ডায়েট
করব ঠিক করেছি। শুধু তাই নয় এখানে একটা জিমেও ভর্তি হব। যে কটা দিন এখানে আছি, এ সময়ের
মধ্যে রোগা হয়ে আবার মুম্বই ফিরে যাব।‘’
‘’ এখানে ভাল জিম কোথায়? এই অজপাড়াগাঁয়ে তুমি
জিম খুঁজছ ?’’
‘’ কেন? শুনলাম নাকি, এখানে ভাল জিম আছে।‘’
‘’ তাহলে হয়ত আছে। তবে আমার জানা
নেই।‘’
জয়ী
কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘’ তুই এবার কিছু কর, একটা চাকরির চেষ্টা কর।‘’
মনে
হল কথাটার মধ্যে অনেকটা ঠেস রয়েছে। আমি বললাম, ‘’ করছি তো।‘’
‘’
আর দাড়িগুলো কাট। একটু ভদ্র লাগবে।‘’
‘’
দাড়ি না কাটলে বুঝি ভদ্র হওয়া যায় না ?’’
‘’
না! অন্তত তুই তো নয়।‘’ জয়ী কথাটা শেষ করে উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
ঠিক
এই ভাবেই আমাদের বিকেলগুলো কেটে যেত। চায়ের থেকে আড্ডা না দিয়ে মনে হত জয়ীর সঙ্গে
সময় কাটায়। আমার দিনগুলো কেমন ভাল কাটত ওর সঙ্গে কথা বলে। হয়ত মনের ভুল, তবুও কেমন
অন্যরকম লাগত। হয়ত ওটাই শুরু।
জয়ী
বই পড়তে বেশ ভালবাসে। নিজের একগুচ্ছ বই নিয়ে এসেছিল, তারপরেও প্রায় প্রতেকদিন আমার
বইগুলো নিয়ে পড়ত, আমার লেখা যে যে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, সেইগুলোও নিয়েও ওর
জিজ্ঞাসা ছিল অপরিসীম। এই নিয়েই বেশ কাটছিল আর সঙ্গে ছিল ওর ছোট্ট মেয়েটা, যাকে
নিয়ে বাড়ির সবাই মেতে থাকত। দিনগুলো কেমন কেটে যেত।
একদিন
জয়ীকে হঠাৎ বললাম, ‘’ বিকেলে বাড়ি না বসে থেকে আমরা একটু হেঁটে আসতে পারি তো ?’’
জয়ী একটু থেমে বলল, ‘’ আমি আর তুই? বাড়িতে কী ভাববে ?’’
‘’
কী আর ভাববে, বলবে আমি সঙ্গে যাচ্ছি!’’
‘’না,
মানে আমি আর তুই!’’ জয়ী সে দিন যে সংকোচের কথা বলতে চেয়েছিল, হয়ত সেটা সেদিন মুখ
ফুটে বলে দিলে আজকে আমাকে দুঃখ পেতে হত না।
(১১)
হাওয়া
বইছে। আকাশটা আরও নীল। পলাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এদিকে-ওদিকে। লাল মাটির পথে খেলা
করছে কৃষ্ণচূড়ার দল। হয়ত এটাই বসন্ত। হয়ত এটাই আমাদের প্রেমের মাস। শান্তিনিকেতন
সারা বছরই এমন থাকে। এখানে ক্যালেন্ডার দেখার প্রয়োজন নেই। এখানে প্রত্যেকটা মাস
প্রেমের মাস, প্রত্যেকটা দিন প্রেমের দিন।
এখন আমার ঠিকানা এই শান্তিনিকেতনের ছোট্ট বাড়িটা। বছরের
একটা বড়ো সময় এখানেই কাটায়। দোতলা এই বাড়িটা অনেকটা গোলাকৃতি। লাল রঙের এই বাড়িটায়
কেমন একটা অদ্ভুত মিষ্টতা আছে, একটা প্রেমের গন্ধ আছে। আসবাবপত্রগুলো বেশ পুরনো
কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর। সামনে একটা ছোট্ট বাগান আছে। একটু হাঁটলেই কোপায়। প্রতি
শুক্রবার হাটে যায়। বাউলদের সঙ্গে সময় কাটায়। প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখি।
চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছি, তবে কোম্পানির অনুরোধে কয়েকটা কপি এখনও দেখে দিই, ওই মেলে
যেটুকু হয়।
প্রকাশকদের বায়না আসে, তবে আমি এখন বড্ড সিকেলটিভ। একজন
স্থানীয় যুবক সকালে এসে বাজার আর রান্না-বান্নাটা করে দেয়, বাকিটা আমিই করেনি।
বছরে কেয়ক মাসের জন্য কলকাতায় ফিরি। মিছিল এখন ক্লাস এইটে
পরে। সোহাগ এখন ওয়ার্কিং ওমেন। দুজনেই ডিভোরসের আবেদন করেছি। হয়ত আর কয়েকমাসের
মধ্যেই হয়ে যাবে। তবে মিউচুয়ালই, আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই।
শেষ দশ বছরে, মাত্র তিনটে বই লিখেছি। একটাও চলেনি। চাকরিটাও
ছেড়ে দিয়েছি। যেটুকু সম্বল ছিল, সেটা দিয়ে এই শান্তিনিকেতনের বাড়িটা কিনেছি। আর আয় বলতে ওই যে কটা কপি দেখি, সেটাই। এর
বাইরে কিছুই নেই।
শান্তিনিকেতনে একটা অদ্ভুত নীরবতা আছে। আমার বারবার মনে হয়,
এইখানে কত দুঃখ চুপ করে আছে, কত কথা লুকিয়ে রয়েছে নিভৃতে। জয়ী যেদিন মারা গেল,
সেদিন আমি দিকশূন্য হয়ে গেছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, জয়ী নেই এটা হতে পারে না। এটা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবটা বড্ড কঠোর।
ওটাই জয়ীর সঙ্গে শেষ দেখা, সেই ছাদে ওটাই আমাদের শেষ কথা
বলা। জয়ী সেদিন বলেছিল, ‘’ আমার সংসারটা একবার ভেঙে গেলে, আর জোড়া লাগাতে পারব না।
কিন্তু তোর সেসব নেই, তুই অনেকটা ফ্রী। তাই আমাকে বাধ্য হয়েই তোকে ভুলে যেতে
হয়েছিল, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কিছুতেই তোকে ভুলতে পারছিলাম না।‘’ জয়ী সেদিন এক
নাগারে বলে চলেছিল, সেদিনর চোখের কোনার জলের ঝিলিকও দেখেছিলাম। সব কথার শেষে জয়ী
বলেছিল, এবার একটা উপন্যাস লেখ, প্রেমের উপন্যাস। আমি বলেছিলাম, ‘’ আমার সবই তো
প্রেমের লেখা।‘’ জয়ী বলেছিল, ‘’ একটু অন্যরকম। একটা অন্য প্রেমের গল্প।‘’
সেদিন আর কিছু মাথায় আসেনি। তারপর কিছুদিনের মধ্যে জয়ী চলে
গেল। হারিয়ে গেল ওই তারাদের ভিড়ে। সেদিন ভেবেছিলাম, আমাদের চেয়ে সেরা প্রেমের গল্প
হতে পারে না। ভেবেছি আর কিছুদিনের মধ্যে উপন্যাসটা শেষ করব। জয়ীকে উৎসর্গ করব ‘’বছর
দশেক পর’’।
(১৩)
জয়ী এই মফস্বলে থাকতে একদম পছন্দ করত না।
কলকাতায় মানুষ হয়েছে তাই এই ছোট্ট শহরটা জয়ীর কাছে বড্ড বেমানান। শুধু তাই নয়, ওর
শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা একটু আদায়-কাঁচকলায়!
যদিও
আমরাই একটা মতলব আঁটলাম! আমাদের বাড়িটা যেহেতু শরিকি বাড়ি তাই বাড়ির দুটো প্রবেশ দ্বার।
আমরা ঠিক করলাম আমরা প্রতিদিন একই সময়ে দুটো আলদা দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটি নির্দিষ্ট
স্থানে গিয়ে দেখা করবে। আর কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব আমরা আলদা গিয়েছিলাম, রাস্তায় দেখা
গিয়েছিল।
আমাদের
সেই দিনের মতলবটা আমাদের আরও কাছে নিয়ে এসেছিল। আমরা এক অন্যকে আরও জানতে পেরেছিলাম।
এই বিকেলগুলোই আমরা সারাদিনের জমানো কথা প্রাণ পেত।
‘’ ধুস,
এখানে কিছু নেই! একটা কফি শপও নেই।‘’
‘’ এটা
মফস্বল! কলকাতা নয়।‘’
‘’ তা
বলে একটা কফি শপ থাকবে না ?’’
‘’ বোকার
মতো কথা বল না!’’
‘’ তুই
দিনে দিনে আমার অভিভাবক হয়ে যাচ্ছিস।‘’
‘’ ক্ষতি
কী! তুমি আমার বাইরের অভিভাবক আর আমি তোমার ভেতরের।‘’
জয়ী
একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। কিছু বলল না। অনেক না বলা কথা অনেক কিছু বলার
থেকেও অনেক বেশি। হয়ত সেদিন সেটাই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। আর পেরেছিলাম বলেই দুটো পাশাপাশি
ঘরে থাকা দুটো মানুষ সারা রাত জেগে একে অন্যকে মেসেজ করত, ফোনে কথা বলত। এই শুরু, আমাদের
কাটাকুটি খেলার।
জয়ী
তখন বত্রিশের কোঠায়। যৌবন শেষ হওয়ার আগে আরও একবার জেগে উঠেছে। ভরাট বুক। ঠোঁটের কোনার
ছোট্ট তিলটা আমাকে আরও প্রশয় দিত। নরম হাতে যখন আমাকে ছুঁত, মনে হয় শিরায় শিরায় বিপ্লব
শুরু হল। নাভির বৃত্তটা আমার মাথার মধ্যে ঘূর্ণির সৃষ্টি করত। একটা অমসৃণ পিঠের তোলপাড়
হওয়া ঝড় আমাকে এক ঝটকায় ফেলে দিত। তবুও এই সব কিছুর পরেও আমি শুধু জয়ীকে ভালবেসেছিলাম।
ওর শরীরকে নয়। যদিও অনেকে বলেন, শরীর ছাড়া প্রেম হয় না। যদি সেই সূত্র মেনেও নিই তাহলে
আমারা প্রেম করিনি, কারণ আমাদের মধ্যে কোনওদিন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি।
নভেম্বর
মাসটাও ঠিক এমনি করেই কেটে গেলো। শীতের কামড় সবে মাত্র শুরু হয়েছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম,
আমরা একে অন্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমরা একে অন্যের কাছে আসতে চাইছি।
‘’ আমাদের
সম্পর্কটা কোনওদিনই স্বীকৃতি পাবে না।‘’
‘’ জানি!
আমরা কোনওদিনই এক হতে পারব না।‘’
‘’ কিন্তু
সারাজীবন আমারা একে অন্যের কাছে থাকতে পারি।‘’
‘’পারি
তো!’’
‘’ কিন্তু
জয়ী, এইভাবে নয়।‘’
‘’ মানে?’’
জয়ীকে
এক ঝটকায় টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। সন্ধ্যের পর এই ছাদে এউ আসে না। এইদিকে কোনও লাইটও
নেই। তাই এটাই এখন আমাদের মান-অভিমানের মঞ্চ। ইচ্ছে করছিল জয়ীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে
দিই, কিন্তু পারলাম না। জয়ী ছাড়িয়ে নিল।
‘’ তুই
জানিস আমি বিবাহিত।‘’
‘’ সব
জানি জয়ী, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি ভাল থাকতে পারব না।‘’
‘’ বোকার
মতো কথা বলিস না।‘’
‘’ আমাকে
ছুঁয়ে বল, তুমি আমাকে ভালবাস না ?’’
জয়ী
সেদিন আর কিছু বলেনি। শুধু সেদিন কেন আজও এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে, জয়ী এড়িয়ে যায়।
আমারা জানতাম আমরা কোনওদিন এক হতে পারব না, কিন্তু তাও সেদিন কেউ কাউকে একবারেও জন্যও
আটকায়নি। আমরা এক হতে চাইছিলাম।
একদিন
সন্ধ্যেবেলা আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি, হঠাৎই আমার কাছে একটা অপ্রত্যাশিত ফোন এলো। আমার
স্বপ্নের ডাক। বাংলার সেরা পত্রিকায় ইন্টারভিউ-এর ডাক পেলাম। যদিও খুশিতে বেশ ডগমগ
ছিলাম, কিন্তু যদি না পায় সেই ভয়ও হচ্ছিল। জয়ী আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার হাতটা
ধরে বলেছিল, ‘’ তুই পারবি, দেখিস।‘’ আমি বলেছিলাম, ‘’ যদি চাকরিটা পেয়ে যায়, তাহলে
তোমাকে জয়ী বলে ডাকব।‘’ ও বলেছিল, ‘’ আচ্ছা, তাই বলিস।‘’
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/02/blog-post_11.html ( দ্বিতীয় পর্ব )
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/02/blog-post_11.html ( দ্বিতীয় পর্ব )
তারপর
বাকিটা হয়ত লেখাই ছিল। আমিও চাকরিটা পেয়ে যায়। সেই সাধারণ মেয়েটা তারপর থেকে জয়ী হয়ে
যায় সবার কাছে। ওর আসল পরিচয়টা চিরকালই গোপন থাকবে। কারণ আমি কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু
যতই জয়ীর চলে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছিল, জয়ী ততই আমাকে এড়িয়ে যেত। বুঝতাম না কেন, বহুবার
জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পেতাম না। ফোন ধরত না, মেসেজ করত না এমনকী হাঁটতেও যেত না
বিভিন্ন শারীরিক অজুহাতে। আমার জয়েনিং-এর দিন যতই এগিয়ে আসছিল, জয়ী আমাকে ততই এড়িয়ে
যাচ্ছিল।
‘’ তোমার কিসের এত
অহংকার?’’
‘’ কোথায় অহংকার ?’’
‘’ প্রতি মুহূর্তে তো সেটাই দেখাচ্ছ!’’
‘’ কখন দেখালাম ?’’
‘’ কাল সারাদিন রিপ্লাই দাওনি! যখন দেখা
করতে গেছি, এড়িয়ে গেছো, বলেছ ব্যস্ত আছি।‘’
‘’ আবার বাচ্চাদের মতো করছিস। তুই নিজেই
দেখেছিস, কাল বাড়িতে লোকজন এসেছিল। তারমধ্যে মেয়েটার জ্বর এসেছে, কখন কথা বলব বল।‘’
‘’ সেটা কালকের ঘটনা, কিন্তু বাকি দিনগুলোও
এইভাবেই কাটিয়ে দাও। ‘’
‘’ তুই আবার বাজে কথা শুরু করলি, এই জন্যই…’’
‘’ জানি তুমি কী বলবে! এই জন্যই আমার সঙ্গে
থাকতে তোমার ভাল লাগে না। তাহলে আছো কেন? কয়েকটা গালাগাল দিয়ে চলে যেতে পারো তো!’’
‘’ তুই কিন্তু এবার বারাবারি করছিস।‘’
‘’ কিচ্ছু করছি না! যা বলেছি , একদম ঠিকই
বলেছি।‘’
‘’ আমি কিন্তু সত্যি চলে যাব।‘’
‘’ যাও না, কেউ তো তোমায় আটকে রাখেনি।‘’
তুই কিন্তু আজ খুব উল্টো-পাল্টা বকছিস!’’
‘’ তুমি আর কথা বলো না। উল্টো-পাল্টা কে
বকছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে! কার কিসের প্রয়োজন, সবই জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।‘’
‘’ এবার কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই চলে যাব।‘’
‘’ ভয় দেখিও না। তোমাকে আমার চেনার আর
বাকি নেই। তুমি শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে খিল্লি
করো আর অসময়ের সঙ্গী ভেবে সময় কাটাও। আমাদের মধ্যে কোনও ভালবাসা নেই। সব মিথ্যে, সব
নাটক!’’
‘’ আমার সঙ্গে আর
কোনওদিন কথা বললি না!’’
‘’ কেন ? তোমার মতো পেটে বিদ্যে নেই বলে
? নাকি তোমার মতো কাউকে নিয়ে খিল্লি করতে পারি না বলে ?’
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমেছে। দুটো ঘরেরই
দরজা বন্ধ। জয়ীকে সন্ধ্যের পর আর দেখেনি। আমারও মনটা অস্থির হয়ে উঠছে। বারবার ফোনের মেসেজ চেক করছি। একটার পর একটা
সিগারেট জ্বালাচ্ছি। উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করছি। ঘড়িতে রাত বারোটা দশ। গলির কুকুরগুলোর
আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি শুধু। বাধ্য হয়ে জয়ীকে ফোন করলাম। জয়ী ফোনটা কেটে দিল। আমি জানতাম, জয়ী মেয়েকে
অনেক আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তারপর আমার সঙ্গে কথা বলে।
কিন্তু আজ সবই উল্টো-পাল্টা হচ্ছে।
হঠাৎ জয়ী মেসেজ করল, ‘’ কী হয়েছে?’’ আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘’ কথা আছে!’’ জয়ী বলল, ‘’
আজ আমার শরীরটা ভাল লাগছে না! কাল যাওয়ার আগে কথা বলব।‘’ আমার হঠাৎ চমক লাগল, যাওয়ার
আগে মানে ? জয়ী কোথায় যাচ্ছে ? রিপ্লাই দিলাম , ‘’ কোথায় যাচ্ছ ?’’ জয়ী উত্তর দিল,
‘’ বাড়ি ফিরে যাব কাল। আমি আর এখানে থাকব না !’’
আমার পৃথিবীটা হঠাৎ কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।
আমি ভেঙে পড়লাম। যে আমি বিকেলে জয়ীর সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য বীরপুরুষ হয়ে গেছিলাম, সেই
আমি হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। জয়ীকে মেসেজ করে বললাম, ‘’ প্লিজ চলে যেও না!’’ কিন্তু
জয়ী আর রিপ্লাই দিল না। একবার নয় বহুবার মেসেজ করেও জয়ী কোনও উত্তর দিল না। বিভিন্ন
প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। একটা ঘোরের মধ্যে রাতটা কেটে গেলো!
যখন সকাল হল, তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে দশটা।
বাড়িতে বেশ লোকজনের আওয়াজ পাচ্ছি। আমার একঝটকায় গতকালের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেলে। বিছানা
ছেড়ে একদৌড়ে সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম, জয়ী চলে যাচ্ছে। কাঁধে
একটা ব্যাগ আর কোলে মেয়ে। সামনে একজন জয়ীর সুটকেস নিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে।
আমার মনে হল, চিৎকার করে জয়ীকে ডাকি। কিন্তু পারলাম না! মনে
পড়ে গেলো, আমরা একে অন্যকে কথা দিয়েছিলাম, আমাদের প্রেমটা গোপন থাকবে। জয়ী একবারের
জন্যও পিছনে ফিরে তাকাল না। চলে গেলো অভ্যাসের মতো। আমি সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। মনে হল
আমার জীবনটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সব শেষ হয়ে গেলো।
তারপর
একটা বছর কেটে গেছে, এই বারেও পুজোটা এলো আবার চলেও গেলো। চলে গেলো শেষ ভ্যানটাও।
আবার মাতালদের নাচ দেখে মনে হল, জয়ী চলে যাওয়ার পর তো আমিও মাতাল হয়ে গেছি।
চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছি। বেকারদের
কীইবা নবমী আর কীইবা দশমী। পুকুর ধারে এসে সিগারেট ধরলাম, ধরাতে ধারতে দোতলার
জানলার দিকে তাকাতেই দেখলাম, কেউ নেই। জয়ী এইবার পুজোয় আসেনি, হয়ত আর কোনওদিনও
আসবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন