বছর দশেক পর
দ্বিতীয় পর্ব
আদিত্য ঘোষ
(৫)
‘’ জানো,
কোনওদিন ভাবিনি যে আমার বইগুলো এত বিক্রি হবে।‘’
‘’ আমি
কিন্তু জানতাম।‘’
জয়ীর
চোখের দিকে তাকালাম। সেই দশ বছর আগের দিনগুলো মনে পরে গেল। ঠিক ও আমার দিকে যে ভাবে
তাকাত, সেই দৃষ্টি। সেই আদরমাখা অনুভূতি। একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘’ কী করে জানতে
?’’ জয়ী একটু হেসে বলল, ‘’ সব কিছু ভাষায় প্রকাশ
করা যায় না। কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।‘’ ‘’ তুমি আমার লেখার কোনওদিনই প্রশংসা করোনি।‘’
জয়ী
ওই দূরের বটগাছের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘’ প্রশংসা করিনি ঠিকই কিন্তু কোনওদিনই বাজেও তো
বলিনি।‘’
‘’ শুধু
একটা দুঃখই রয়ে গেল।‘’
‘’কী?’’
জয়ী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল
‘’ মাঝের
যে সময়টা তুমি আমাকে এড়িয়ে গেছো, যে সময়টা তুমি ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে...’’ জয়ী আমার
কথা থামিয়ে বলল, ‘’ থাক! বাকিটা আর বলতে হবে না। তুই এখনও বাচ্ছাই রয়ে গেলি।‘’
‘’ এখনও
কেন, হয়ত তোমার কাছে সারাটা জীবনই এইরকম থেকে যাব।‘’
‘’ তবে
তুই এখন অনেক পরিণত, অনেক এসট্যাবলিস্ট।‘’
‘’হুমম।
কিছুটা, এখন অনেকটা পথ আছে।‘’
‘’ তোর
কেরিয়ারে ওটাই টারনিং পয়েন্ট।‘’
‘’ কোনটা
? তোমার চলে যাওয়াটা ?’’
জয়ী
হাসতে হাসতে বলল, ‘’ এবার মার খাবি!’’
আজ থেকে
বেশ কয়েক বছর আগে, যে বাড়িটার নাম অস্থাবর রেখেছিলাম সেটা এখনও তাই আছে। আমাদের বাড়িটা
এখনও ভাগ হয়নি, হয়ত কোনওদিনও হবে না। তবে বাড়িটা আরও জীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই বাড়িটা
প্রতি একটা টান এখনও রয়ে গেছে। রাতের বেলায় আড্ডা দিতে বেরোলেই মনে হত রাত ন’টার মধ্যে
বাড়ি ফিরতে হবে। যদিও মা-বাবার কোনওদিনই বাধ্য ছিলাম না, তবুও কেন জানি ন’টা বাজলেই
বাড়িটার জন্য মন কেমন করত। আমার একলা ছাদটার জন্য মন কেমন করত। মনে হত কখন সেই আলো-
আঁধারি মেশানো ছাদটায় গিয়ে দাঁড়াবো, কখন সিগারেটটা ধরাব। যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলাম,
সেদিন আমার সেই ছাদটার জন্য মন কেমন করছিল। আজ সেই দশ বছর পর, আবার আমার প্রিয় ছাদে
এসে দাঁড়িয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
(৬)
বাড়িটার
বয়স প্রায় দেড়শ বছর। এই আমলে শরিকি বাড়ি প্রায় উধাও। ফ্ল্যাট কালচারে এমন শরিকি বাড়ি অনেকটা ইউনিটি ইন
ডাইভার্সিটির মতো। তবে শুধু বাড়িটাই, বাকি সবটাই রাজনৈতিক দলের মতো! এ বলে আমায়
দেখ, ও বলে আমায় দেখ। কেউ একটুও জমি ছাড়তে নারাজ। ছোট থেকেই এমনটা দেখতে দেখতে বড়
হয়েছি। বাবার মুখে যদিও শুনেছি, দাদুদের আমলে খুব মিলমিশ ছিল। তখন নাকি এখানে
সারাদিন রোদ্দুর খেলা করত। তখন এখানে ভিড়
করত টিয়া, শালিক, ঘুঘু আরও কত কেউ। বাড়ির
সামনে পুকুরে তখন মাছরাঙারও দেখা মিলত। আমিও দেখছি, তবে তখন আমি অনেক ছোট। আমাদের
বাড়ির দুটো দরজা, তবে পুকুর ধারের দরজাটাই সদর দরজা বলে পরিচিত।
বাড়ির একেবারে
মাঝখানে একটা মস্ত বড়ো আম গাছ ছিল। ঝড়ের রাতে আম কুড়োনোর স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। তখন
হয়ত ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্স। মে মাসের শেষের দিক। বাইরে তখন কালবৈশাখীর তাণ্ডব
চলছে। লোডশেডিং এর মধ্যে একফালি মোমবাতি ছিল আমার আলোর উৎস। তখনও বাড়িতে ইনভাটারের ব্যবহার শুরু
হয়নি। সেই ঝড়ের রাতে আম কুড়োনোর জন্য অধীর
আগ্রহে বসে থাকতাম, কখন ঝড় কমবে আর আমি কখন গিয়ে আম কুড়োবো। যেদিন এই আম গাছটা
কেটে ফেলা হয়, সেদিন আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, শৈশবের একটা শিকড় কেউ
ছিঁড়ে ফেলছে। আমার সেই কালবৈশাখীর সন্ধ্যে কেউ কেড়ে নিতে চাইছে আমার থেকে।
আমাকে
কেউ বলেছিল, ‘’ ভালবেসে কাঙাল হতে চাই না!’’ আমি তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, ‘’ ভালবাসলে
তো একদিন না একদিন তোমাকে কাঙাল হতেই হবে।‘’ যতই পজিটিভ হোক আমাদের সম্পর্ক, যতই সখ্যতা
থাক আমাদের মধ্যে কিন্তু এমন কোনও পরিস্থিতি আসবে না তো কোনওদিন যা আমাদের আরও দূরে
নিয়ে যাবে, এই ভেবে এখনও ভয় হয়। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এখনও শীতের দুপুরে্......
তখন
জুন মাসের শেষের দিক। বাড়িতে তখন সাজসাজ রব। এই বাড়িতে প্রথমবার কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানকে
উপভোগ করতে পারব এই ভেবে আনন্দ হচ্ছে। আমার মনে পড়ে না এর আগে এই বাড়িতে কোনও
বিয়ে দেখেছি কিনা! আমি তখন ক্লাস টুয়েলভে। পরের বছরেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, যদিও
তখনও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমিই আমাদের পরিবারের মধ্যে একমাত্র যে
কিনা একটু ট্যারাব্যাকা! মানে, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও রীতিমতো সাহিত্য চর্চায় মেতে
থাকি।
যদিও গর্বের ব্যাপার নয়, অনেকেই এটা নিয়ে প্যাঁক দেয়! তবে ওসব আমার গায়ে
লাগে না। হাল্কা হেসে উড়িয়ে দিই। আমাদের পরিবারে বেশিভাগই সরকারী চাকরি করে কিংবা
করত আর কেউ কেউ ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত তবে কেউই সাহিত্যের সঙ্গে
যুক্ত নেই অথবা সেইটাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। আমি একমাত্র বীরপুরুষ যে এই অনিশ্চয়তার
দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! ভাবলে নিজেরই কেমন হাসি পায়।
(৭)
‘’ লন্ডনের দিনগুলো তো এবার
মিস করবে। টেমসের জন্য মনখারাপ হবে না ?’’
জয়ী একটু মুখটা বেঁকিয়ে বলল,
‘’ ধুর! নিজের দেশের মতো কোনও জায়গায় হয় না। সারাদিন শুধু ঠাণ্ডা। তুই জানিস, আমি
বেশি ঠাণ্ডায় থাকতে পারি না।‘’
‘’ এখন তো কোনও অসুবিধা নেই, এবার থেকে তো সেই তোমার সাজানো
ফ্ল্যাট।‘’
‘’হ্যাঁ, জানিস দেশে ফিরে
খুব ভাল লাগছে। সবকিছু আবার আগের মতো লাগছে।‘’
‘’ সবকিছু
?’’
‘’
হ্যাঁ, সবকিছু।‘’
‘’আমাদের
সময়টা কি একই আছে ?’’
‘’
সেটা তো এক থাকার কথা নয়!’’
‘’
যেদিন তুমি দেশ ছেড়ে চলে গেছিলে, সেদিন একবারের জন্যও জানিয়েছিলে ?’’
‘’
তুই একবারও জানিয়েছিলিস ?’’
‘’
কী জানাব ?’’
‘’
তুই যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলিস।‘’
‘’
তখন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে না।‘’
‘’
তুই জানিস, সেটা ইচ্ছেকৃত নয়।‘’
একটা
মৃদু হাওয়া বইছে। রোদ্দুর খেলা করে বেরাচ্ছে আমাদের দালান জুড়ে। রোদের আলোয় জয়ীর
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওর ছিপছিপে শরীরটাও এই ঝরা পাতার মরসুমেও যেন মোহময়ী।
জয়ী আমার নীরবতা দেখে বলল, ‘’ তোর কাছে কিন্তু আমার অনেক অভিযোগ আছে।‘’ আমি একটু
অবাক হয়ে বললাম, ‘’ কী ?’’ ‘’ সোহাগের কথা তুই কিন্তু আমাকে কিছুই বলিসনি।‘’
‘’ কী
আর বলব, ধরে নাও তোমার শূন্যতা পূর্ণ করতে যে পারে , সেই সোহাগ।‘’
জয়ী
একটু হেসে বলল, ‘’ আমার কথা সে জানে?’’
‘’
আলবাত জানে। সব জানে।‘’
‘’
কিছু বলে না ?’’
‘’
বলে, তুমি না থাকলে ও আমার জীবনে আসত না।‘’
‘’
আবার বাজে বকছিস।‘’
আমি
জয়ীর হাতটা ধরে বললাম, ‘’ তোমাকে ছুঁয়ে বলছি!’’
সেই
আগের দিনগুলো আবার মনে পরে গেল। ঠিক যেমন ভাবে জয়ীকে বিশ্বাস দিতাম, ঠিক সেইভাবে
দশ বছর পরেও। জয়ী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘’মিথ্যে বললে আমি কিন্তু মরে যাব,
তুই জানিস।‘’
‘’
আজ পর্যন্ত তোমাকে ছুঁয়ে কোনওদিন মিথ্যে বলেছি ?’’
হঠাৎ
মনে পরে গেল, হ্যাঁ একবার মিথ্যে বলেছিলাম। সেইবার কলেজ ট্রিপে যখন ডুর্য়াস গেছিলাম, তখন জয়ী বারবার বলেছিল ‘’ শুকনো নেশা
করবি না।‘’ কিন্তু তাও করেছিলাম। সেটা এখনও জয়ী জানে না। হয়ত কখনও জানতেও দেবো না।
জয়ী বলল, ‘’ কী ভাবছিস ?’’ ‘’ না কিছু না।‘’
(৮)
বিয়ে
বাড়িতে গিয়ে প্রথম সেই মেয়েটাকে দেখি। আমি তখন স্কুলে। স্কুল জীবনের সেটাই শেষ বছর।
তবে সেই মেয়েটার মধ্যে সেদিন তেমন কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পাইনি। আর পাওয়ারও সুযোগ পাইনি,
কারণ সেই মেয়েটা তখন বিয়ের পিড়িতে। সে তখন একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে আর আমি
একজন নতুন আত্মীয় পাচ্ছি, ব্যস একটুকুই খুশি ছিল, এই বাইরে কিছু নয়। তবে সেই মেয়েটার
মধ্যে সেদিন তেমন কিছু বিশেষত্ব খুঁজে না পেলেও এইটুকু বুঝেছিলাম, এই মেয়েটা বড্ড বাচাল!
হ্যাঁ, একদম উড়নচণ্ডী। বিয়ের পিড়িতে বসেও দিব্যি ইয়ার্কি মারছে, হাসছে, ছবির জন্য পোজ
দিচ্ছে। কোনও চিন্তাই তাকে ছুঁতে পারেনি সেদিন, শুধু সেদিন কেন, আজও পারিনি।
আজও অসময়ে
তার মুখটা মনে পরলে, শুধু হাসতেই দেখি। আর আমিও হাসি এই ভেবে যে, একদিন যার বিয়েতে
গিয়েছিলাম সেই মেয়েটা হঠাৎ কীভাবে আমার খেলাঘরের সঙ্গী হয়ে গেছে।
হয়ত যা হয়েছে ভালর
জন্যই হয়েছে, যা হচ্ছে সেটাও ভালর জন্যই হচ্ছে।
সময়টা
ঠিক দুর্গা পুজোর আগে। হঠাৎই একটা ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ঠিক হয়। সঙ্গী বলতে সেই মেয়েটা
এবং তার বর। আসলে আমরা তিনজনই আত্মীয়স্বজন । গন্তব্য শান্তিনিকেতন। আমি তখন কলেজ ছেড়ে
দিয়ে কবিতা লেখায় মন দিয়েছি। পাশাপাশি থিয়েটারটা চলছে সঙ্গে ম্যাগাজিনের সম্পাদনার
কাজ করছি। যদিও সেই আধুনিক মেয়েটা আমার সামনে যতই আমার প্রশংসা করুক না কেন, পিছনে
পিছনে এই ব্যাপারটাকে নিয়ে যে সে হাসত সেটা আমি জানি!
আসলে সে কোনওদিনই শিল্পীকে বোঝেনি,
হয়ত আজও নয়। কলেজ ছেড়ে দিয়ে একটা তরুণ যুবক এই সমস্ত আঁতলামি করছে, লেঙ্গি খেয়ে কবিতা
লিখছে এইসব তার একেবারেই অপছন্দ ছিল। আমার এখন মনে আছে সেই প্রথম আমরা তিনজন একসঙ্গে
মদ খেয়েছিলাম। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। যদিও সেই মেয়েটা আমাকে বারবার সাবধান করেছিল,
‘ বেশি মদ খাস না! বমি করলে কিন্তু আমি পরিষ্কার করব না।‘ কিন্তু আমি সেদিন নেশায় হারিয়ে
গিয়েছিলাম, বমিও করেছিলাম এবং সেই মেয়েটাই বমি পরিষ্কার করেছিল! তখনও কিন্তু আমাদের
প্রেমটা শুরু হয়নি, তখনও আমরা আত্মীয়স্বজন।
তবে রান্না করার ব্যাপারে সে চিরকালই একটু ‘লেটুস’। আমিও কোনও কোনও দিন তার সহকারী হিসেবে কাজ করতাম, তবে বিনা পারিশ্রমিকে নয়। সে আমাকে সারাদিন বিভিন্ন গল্প কথায় ভুলিয়ে রাখত। সারা মুম্বই আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুরে বেড়াত। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে বেশ অধ্যাপকদের মতো খবর শোনাত। আবার ব্যাডমিন্টনও খেলত। সুযোগ পেলে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দৌড় দিত। রাত নামলে আমরা তিনজন একসঙ্গে বসে মদও খেতাম। অনেক গল্প হত। কিন্তু তখন সেই মেয়েটার মধ্যে কোনও বিশেষত্ব খুঁজে পাইনি। সেই মেয়েটা তখনও শুধু সেই একজন বন্ধু ছিল, এর বেশি কিছু নয় । ( পরবর্তী পর্ব আগামী সপ্তাহে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন