আদিত্য ঘোষ
(১)
‘’ বার্ধক্য
তোমাকে পেয়ে বসেছে।‘’
‘’ বয়সটাও
তো কম হল না।‘’
‘’ তবে
তুমি কিন্তু এখনও আমার কাছে যুবতী!’’
‘’ ধুস!
সময়টা কতটা বদলে গেছে বল তো।‘’
‘’ সময়টা
একই আছে, আসলে আমাদের চরিত্রটা পাল্টে গেছে।‘’
‘’ এটাও
তো একটা বসন্ত। দেখ, সেই ঝরা পাতার মিছিল।‘’
‘’ তুমি
কি এখনও কাব্য কর ?’’
‘’ মনের
মানুষ পেলে করি।‘’
‘’ তুমি
আমার মনেই থেকে গেলে, তোমাকে আর পাওয়া হল না।‘’
‘’ এখনও
আক্ষেপ করিস?’’
‘’তা
একটু করি!’’
জয়ী
হেসে উঠল। ওর হাসিতে সেই আগের মতো উচ্ছ্বাস লেগে আছে। যে উচ্ছ্বাসটা আমার যৌবনের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। যে
উচ্ছ্বাসটা দেখে ওর প্রেমে পরেছিলাম, সব জেনেও যে ওকে কোনওদিনই পাবো না, তবুও...
গায়ের
রঙে মরচে ধরেছে সঙ্গে চুলেও। চামড়াটা কেমন
এঁকেবেঁকে গেছে সরু নদীর মতো। চশমার কাঁচটা আরও মোটা হয়েছে। ঠোঁট দুটোও কেমন ফ্যাকাসে,
লিপস্টিক দিয়ে সেটা ঢাকার চেষ্টা হয়েছে। চোখের নীচে কালির ছাপ, চিন্তার ভাঁজ। সেই তিলটা, যেটা আমাকে বারেবারে ডাকত মধ্যরাতে সেটাও
কেমন যৌবন হারিয়ে নিস্তেজ। আগের চেয়ে জয়ী এখন
অনেক রোগা হয়ে গেছে। যৌবনের সেই ঝাঁঝটা এখন নেই।
‘’ অমন
করে কী দেখছিস ?’’ জয়ী বলল। ‘’ তোমাকে, তোমার আগের তুমিকে খুঁজছি!’’ একটু মুচকি হেসে
জয়ী বলল, ‘’ পাবি না! খোঁজারও চেষ্টা করিস না।‘’
‘’ শুধু
কি সময়টায় বদলে গেছে নাকি আমাদের দেখার দৃষ্টিটাও ?’’ জয়ী কিছুক্ষণ চুপ থেকে রইল। তারপর
আস্তে আস্তে বলল, ‘’ মেয়েরা সবসময় এমন কাউকে চাই, যে স্থায়ী! মেয়েরা যতই স্বাধীনচেতা
হোক না কেন, দিনের শেষে সে এমন কাউকে চাইবে যে তাকে সুখ দেবে, ভালবাসা দেবে।‘’
‘’ আমি
তো এখনও স্থায়ী নয়! এখনও প্রতিদিন ভালবাসা খুঁজি।‘’
‘’ ধুস,
তুই স্থায়ী না হলে সোহাগের মতন মেয়েকে কোনওদিনই পেতিস না।‘’
‘’ ও
তোমার শূন্যতাটা পূর্ণ করেছিল। তাই ওকে ভালবেসে ফেলেছিলাম।‘’
‘’ আমি
তোকে কোনওদিনই শূন্য করতে চাইনি। চেয়েছিলাম তুই আরও মনের থেকে শক্ত হতে শেখ। আমাকে
ছাড়া বাঁচতে শেখ।‘’
একটা
মৃদু হাওয়া বইছে। বসন্ত আজও এসে থমকে আছে কোনও প্রেমহীন নগরীতে। আমাদের সেই ছাদটা এখন
ভগ্ন প্রায়। শ্যাওলা জমেছে আমাদের স্মৃতিতে। উঠোনটা এখন আগের মতোই আছে। শুধু আমাদের
বয়সটা বেড়ে গেছে। চরিত্রটাও বদলে গেছে।
(২)
’ কার
সঙ্গে কথা বলছিলে?’’
‘’ বরের
সঙ্গে!’’
‘’ প্রায়
আধ-ঘণ্টা ধরে ফোনটা ব্যস্ত বলছিল।‘’
‘’ হ্যাঁ,
কিছু ব্যক্তিগত কথা বলছিলাম।‘’
‘’ বরকে
ছেড়ে এতদিন এই বাড়িতে ভাল লাগছে?’’
‘’ একদমই
না! কবে চলে যেতে পারব ভাবছি।‘’
‘’ আমাকে
ছেড়ে চলে যাবে ?’’
‘’ যেতেই
হবে, কাউকে কথা দিয়ে এসেছি।‘’
‘’ আমাকেও
তো কথা দিয়েছিলে, আমার পাশে থাকবে সারাজীবন।‘’
‘’ থাকব
তো, তবে এইভাবে নয়।‘’
দুপুরটা
আজ শান্ত। প্রতিদনের মতো কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে না। পাশের বাড়িতে ঝগড়াটা আজ অনেক আগেই
থেমে গেছে। জানলা দিয়ে পুকুরটা দেখা যায়। পুকুর পাড়ে কয়েকটা অবাঙালী ছেলেদের আড্ডা
বসেছে। প্রতিদিনের মতো পুকুরের ওপাশের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীয়ের মারপিট চলছে। বাবা-মা
তুলে গালাগাল দিচ্ছে একে অন্যকে। জয়ীর এগুলো একদম পছন্দ নয়। অন্যদিনের মতো জয়ী গল্পের
বইতে মুখ গুঁজেছে। জানলা দিয়ে একটা হাল্কা আলো এসে পড়ছে জয়ীর মুখের একপাশে। ডান গালের
তিলটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমিই কথা ঘুরিয়ে বললাম,
‘’ কর্নেল সমগ্রটা শেষ হয়নি এখনও?’’
‘’ না!
দেখিস তো সময়ই পায় না।‘’
‘’ আর
আমি ? তোমার প্রতিদিনের তালিকায় আমি নেই ?’’
‘’ আছিস
তো!’’
‘’ বলো,
শুধুমাত্র প্রয়োজনে আছি।‘’
‘’ বাজে
বকিস না!’’
‘’ আবারও
এড়িয়ে যাচ্ছ।‘’
‘’ বেশ
করছি।‘’ জয়ীর ঠোঁটের কোনায় একটা মিচকে হাসির ঝলক দেখতে পেলাম। জয়ীর হাতটা ধরে একটা
চুমু খেলাম। জয়ী হাসল। জয়ী বুঝতে পারল, এবার আমি কী বলব!
‘’ কিছু
বলবি?’’
‘’ আমাকে
ছেড়ে যেও না!’’
‘’ বাচ্চাদের
মতো করিস না। আমাকে ফিরতেই হবে।‘’
‘’ তাহলে
আমার কোনও মূল্য নেই ?’’
‘’ আবার
পাগলামি করছিস!’’
জয়ীকে
আজ বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। সাদা আর নীল ছোপের সালোয়ারটায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জয়ী। বক্ষদ্বয়
মোহময়ী। চোখের একপাশে বারবার উড়ে আসা চুল ওকে বিরক্ত করছে। আমি সেই উড়ুক্কু চুল সরিয়ে
জয়ীর গালে একটা চুমু খেলাম। জয়ী সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘’ কেউ এসে যাবে!’’
আমি জয়ীর আরও কাছে এসে বললাম, ‘’ কেউ আসবে না।!’’ জয়ী বলল, ‘’ এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে
না।‘’ আমি জয়ীর আরও কাছে গিয়ে বললাম, ‘’ প্রেমে সবকিছুই অবৈধ! সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।‘’
জয়ী আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। একটা অব্যক্ত রাগ দেখতে পেলাম জয়ীর চোখে।
জয়ীর কপাল জুড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন চিন্তার ভাঁজ। আমি সেই চিন্তার ভাঁজে ছুঁয়ে
দিলাম আমার সিক্ত ঠোঁট। জয়ী আমার আরও কাছে চলে এলো। ওর চোখ দুটোই দিলাম আশ্বাসের স্বাদ,
জয়ী আমার বুকে মাথা দিল। তারপর গালে, ঠোঁটে ছুঁয়ে দিলাম আমাদের অবৈধ ভালবাসা। আরও জাপটে
ধরলাম ওকে। গলা
বেয়ে বুকের খাঁজে দাঁড়ালাম, তারপর বাকিটা অনেকটা গল্পের মতো মিশুকে।
(৩)
‘’ জানো, ভেবেছিলাম কোনওদিনই
বিয়ে করব না, কিন্তু হঠাৎ করে যে বিয়েটা হয়ে যাবে, কে জানত!’’
‘’ ওইরকমই হয়!’’
‘’ আমরা যা চাই, সেটার ঠিক
উল্টোটা হয়।‘’
‘’ তার মানে আমরা যদি একে
অন্যকে ঘৃণা করতাম, তাহলে কি আমরা এক হতে পারতাম ?’’
‘’ আবার বাজে বকছিস।‘’
‘’ কতদিন বাদে আমাদের দেখা
হল বলো তো! সেই আগের দিনগুলোকে একবার ঝালিয়ে নিতে চাইছি।‘’
‘’ তুই আবার শুরু করলি...’’
‘’ আমিই তো শুরু করেছিলাম,
শেষটাও আমিই করেছি।‘’
‘’ ভুল বললি, শুরুটা আমরা
করেছিলাম। শেষটা আমি করেছি।‘’
এখানে আর অবাঙালীদের ভিড়
নেই। পাশের বাড়ির ঝগড়াটাও এখন কোথায় হারিয়ে গেছে। বাড়িটার বয়স আরও বেড়ে গেছে। সামনের
বাড়িগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বটগাছটাকে এখন আমাদের ছাদ থেকে দেখা যায়। সেই
বটবৃক্ষ এখনও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই ঝরে পরা পাতাগুলো এখনও প্রেমের ডাক দেয়,
আমাদের ডাক দেয়।
‘’কতদিন বাদে দেশে ফিরলে ?’’
‘’
প্রায় পাঁচ বছর।‘’
‘’
আর তুই কতদিন বাদে বাড়ি ফিরলি?’’
‘’
ওই একই, বছর পাঁচেক তো হবেই।‘’
‘’
মানে, সব মিলিয়ে বছর দশেক পর!’’ জয়ীর ঠোঁটের কোনায় একটা হাল্কা হাসির ঝলক দেখতে
পেলাম। ‘’হ্যাঁ, সব মিলিয়ে আমরা আবার বছর দশেক পর দেখা করলাম ।
‘’জয়ী
একটু হেসে বলল, ‘’ সোহাগ কেমন আছে ?’’
‘’ আছে, ভালই আছে।‘’
‘’ ওকে আনতে পারতিস
তো!’’
‘’ চেম্বার আছে, সঙ্গে হাসপাতাল। তারপর মিছিলকে কে দেখবে, এই সব কারণের
জন্যই আর আনেনি। ওর যদিও ইচ্ছে ছিল, আমিই বারণ করলাম।‘’
‘’ মিছিল নামটা কিন্তু খুব
সুন্দর!’’
‘’ তোমার মেয়ের কী খবর ?’’
‘’ এই তো এবার ক্লাস এইট হলো।‘’
‘’ এখনও
দুষ্টুমি করে?’’
‘’ সে আর বলতে!’’
‘’ মিছিলের কত বয়স হল রে ?’’
‘’এই তো, সামনের
মাসে দুই হবে।‘’
‘’
তোর খবর বল, সামনে কোন বইটা বেরোচ্ছে ?’’
‘’
আপাতত কিছুই নেই। যদিও একটা উপন্যাস লিখব বলে ভেবেছি, কিন্তু কী লিখব জানি না।‘’
‘’
তোর ‘ভালবাসার শহর’ এই কিছুদিন আগেই শেষ করলাম। শুধু আমি নয়, আমার বরও পড়েছে।‘’
‘’
উনি আমার লেখা পড়েন ?’’
‘’
আবার বাজে বকছিস!’’ জয়ীর চোখে সেই অভিমান মেশানো হাসিটা দেখতে পেলাম, আবার সেই
জয়ীকে দেখতে পেলাম।
(৪)
“ তোমার
জন্য দিনে দিনে আরও ক্ষয়ে যাচ্ছি!’’
‘’ আবার
একটা নেগেটিভ গল্প লিখতে বসেছিস। কেউ পড়বে না।‘’
‘’ তুমি
তো পড়বে।‘’
‘’ হয়ত!
সময় পেলে ভেবে দেখব।‘’
‘’ সময়
এখন তোমাকে খুঁজছে, আর আমি খুঁজছি আমাদের ফেলে
আসা সময়কে।‘’
‘’ খুঁজিস
না! শুধুই কষ্ট পাবি।‘’
‘’ কী
আর করব? তোমাকে তো পেলাম না।‘’
‘’ কোনওদিনও
পেতিস না।‘’
‘’ হুম,
পেতাম! যদি তোমার সঙ্গে আগে দেখা হত।‘’
‘’ তাও
পেতিস না!’’
‘’কেন?’’
‘’ আমি
তোর চেয়ে দশ বছরের বড়।‘’
‘’ তাতে
কী হয়েছে? সমাজ মেনে নিত না? আমি থোড়াই সমাজকে তোয়ক্কা করতাম।‘’
‘’ তুই
না করলেও তো, আমি করতাম।‘’
‘’ তোমার
জন্য এখনও সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।‘’
‘’থাক!
অত প্রেমিক হতে হবে না। আমি বেশ ভাল আছি, স্বামী, মেয়ে আর আমি। আমাদের ছোট্ট সংসারে
আর কিছুর অভাব নেই।‘’
‘’ আছে!
তুমি জানো না।‘’
‘’কী
শুনি ?’’
‘’ কিছু
কথা গোপন থাক না।‘’
‘’ ছাড়
বলিস না।‘’
‘’ তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখব জয়ী!’’
‘’ না,
একদম না। তুই জানিস…’’
জয়ীকে
থামিয়ে বললাম, ‘’ সব জানি! কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া ভাল থাকব না।‘’
‘’ ধুর
বাল! তুই যা তো। সেই একই কথা। একই ন্যাকামি। কতবার বলব ওসব ভুলে যা। সেই বাচ্চাদের
মতো নাটক করছিস।‘’ একটু থেমে বললাম, ‘’ নাটক ? ওটা তো তোমার থেকে শিখেছি।‘’ ‘’ বাজে
বলিস না! আমি কোনওদিনও নাটক করেনি।‘’ ‘’ তাহলে একবার বলো ভালবেসেছিলে।‘’
জয়ী বলল,
‘’ চল টাটা! পরে কথা হবে। ‘’
( পরবর্তী
অংশ আগামী পর্বে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন