এখনও আমার আর মৃদুলের কানে সেই কথাটা বারবার বাজে, ‘’ সব প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ নেই,সব সম্পর্কের পরিণতি হয় না।‘’
বিভোর
শেষ পর্ব
আদিত্য ঘোষ
(১৩)
সব সম্পর্কের
পরিণতি হয় না। সব সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত মর্যাদা পায় না। কিছু সম্পর্ক মাঝ পথে ছেড়ে দিতে
হয়। হয়ত এটাই শ্রেষ্ঠ পথ, হয়ত এটাই ভবিতব্য। মৃদুল যতই খুশি থাকুক না কেন, মৃদুল জানত
তাঁর মা এই সম্পর্ক মেনে নেবেন না। এমনিতেই মৃদুল আর সোহাগের সম্পর্কটা অনেক দূর এগিয়েছে।
তারা এখন একে অপরকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না। দুজন এখন দুজনের সর্বক্ষণের
সঙ্গী। আর মিছিল ওদের চোখের মনি। সোহাগ
যেটুকু সময় অফিসে থাকে, সেই সময়টুকুর জন্য একজন আয়া রাখা আছে আর বাকি সময়টা মৃদুল
নয়ত সোহাগ ওর সঙ্গে থাকে। এইভাবেই ওদের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু মৃদুল জানে,
এই সম্পর্কটা একদিন ঠিক শেষ হবে। কারণ সমাজের চোখে এই সম্পর্কটা অর্থহীন। এমনিতেই
সোহাগ মৃদুলের চেয়ে বয়সেও অনেকটা বড়। এখন তো সোহাগ মাঝে মধ্যেই মৃদুলকে তুই তুই
বলেও ডাকে। কিন্তু মৃদুল সোহাগকে তুমি বলেই সম্বোধন করে। ওরা জানে না ভবিষ্যতে
ওদের জন্য কী লেখা আছে। ওরা শুধু নিজেদের প্রেমেই মত্ত।
‘’
তুমি বাড়িতে জানিয়েছ আমাদের ব্যাপারে ?’’ সোহাগ বলল।
‘’
না। তবে ভাবছি মাকে এরমধ্যেই জানিয়ে দেবো। ‘’
‘’
তোমাকে কতবার বলেছি, তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে কিন্তু তুমি তো যাও না।‘’
মৃদুল
আস্তে আস্তে বলল, ‘’ তুমি জানো না, আমি ছোট থেকে কোন পরিবেশে বড় হয়েছি। সেই
পরিবেশে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে না।‘’ সোহাগ মৃদুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘’ পাগল, তুই
জানিস না আমি তোকে কতটা ভালবাসি।‘’ মৃদুল একটু রোমান্টিক হয়ে বলল, ‘’ তাই বুঝি,
তাহলে কতটা?’’
সোহাগ একটু হেসে বলল, ‘’ দেখবি কতটা?’’ মৃদুল বলল, ‘’ দেখি।‘’ তারপর
একে অপরের ঠোঁটে এঁকে দিল এক অসীম ভালবাসা। ছুঁয়ে দেখল আধখানা পৃথিবী। সোহাগ দেখল
একটা কালচে শরীরে অনেকগুলো দুঃখ জমে ছিল এতবছর ধরে, যা সোহাগের স্পর্শে এখন সবুজ
হয়ে উঠল। মৃদুল লক্ষ্য করল, একটা সাদা শরীরের একপাশ-ওপাশ জমাট বেঁধে আছে রক্তে।
মৃদুল সেই সব জমাট রক্তকে সজীব করে তুলল। এক অন্যকে ভরিয়ে দিল ভালবাসায়।
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_7.html(প্রথম পর্ব)
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_7.html(প্রথম পর্ব)
বাড়ি
ফিরতে ফিরতে মৃদুল ভাবল, সে আজ মাকে সবকিছু খুলে বলবে। তাঁদের সম্পর্কের কথা এবার
তাঁর জানা দরকার। বাড়ি ফিরেই মৃদুল তাঁর মাকে বলল, ‘’ মা, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি
কথা ছিল।‘’ এমনিতেই মৃদুল ছোট থেকেই মাকে সবকিছু বলে, কোনওকিছুই লুকিয়ে রাখে না,
কিন্তু সোহাগের কথা কিছুই সে বলেনি, তাই বলার আগে সে কয়েকবার থমকেছে এইভেবে যে
তাঁর মা এই কী বলবে। আদেও কি সে এটা মেনে নেবে ? আর যদি না নেই তখন কী হবে ?
কিন্তু সে আর চেপে রাখতে পারল না।
‘’
বল কী বলবি।‘’
‘’
আমি একজনকে ভালবাসি।‘’
‘’
ভাল তো, এই কথাটা বলার জন্য এই ভাবছিস কী ?’’
‘’
না, মানে কোনওদিন তো তোমাকে এইসব বলেনি
তাই...’’
মৃদুলের
মা একটু হেসে বলল, ‘’ কী করে সে? কোথায় থাকে?’’
মৃদুল
বলল, ‘’ একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে। বালিগঞ্জের কাছে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।‘’
‘’ আর
কে কে আছে বাড়িতে ?’’
‘’ ওর
মা-বাবা আর ওর একটা দুবছরের ছেলে।‘’
মৃদুলের
মা কিছুটা থমকে জিজ্ঞাসা করল, ‘’ ছেলে মানে ?’’
তারপর
মৃদুল সবটা তাঁর মাকে খুলে বলল। সবটা শুনে তাঁর মা বলল, ‘’ একদিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা করাবি না?’’
কথাটা শুনেই মৃদুল যেন চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘’ তাঁর মানে তুমি সম্পর্কটা মেনে
নিলে ?’’ মা হেসে উত্তর দিল, ‘তোর পছন্দ আমি কিছু বলতে পারি ?’’ মৃদুল যেন মায়ের
কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে খুশিতে তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরল।
(১৪)
“ তোমার
জন্য দিনে দিনে আরও ক্ষয়ে যাচ্ছি!’’
‘’ আবার
একটা নেগেটিভ গল্প লিখতে বসেছিস। কেউ পড়বে না।‘’
‘’ তুমি
তো পড়বে।‘’
‘’ হয়ত!
সময় পেলে ভেবে দেখব।‘’
‘’ সময়
এখন তোমাকে খুঁজছে, আর আমি খুঁজছি আমাদের ফেলে
আসা সময়কে।‘’
‘’ খুঁজিস
না! শুধুই কষ্ট পাবি।‘’
‘’ কী
আর করব? তোমাকে তো পেলাম না।‘’
‘’ কোনওদিনও
পেতিস না।‘’
‘’ হুম,
পেতাম! যদি তোমার সঙ্গে আগে দেখা হত।‘’
‘’ তাও
পেতিস না!’’
‘’কেন?’’
‘’ আমি
তোর চেয়ে দশ বছরের বড়।‘’
‘’ তাতে
কী হয়েছে? সমাজ মেনে নিত না? আমি থোড়াই সমাজকে তোয়ক্কা করতাম।‘’
‘’ তুই
না করলেও তো, আমি করতাম।‘’
‘’ তোমার
জন্য এখনও সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।‘’
‘’থাক!
অত প্রেমিক হতে হবে না। আমি বেশ ভাল আছি, আমাদের ছোট্ট সংসারে আর কিছুর অভাব নেই।‘’
‘’ আছে!
তুমি জানো না।‘’
‘’কী
শুনি ?’’
‘’ কিছু
কথা গোপন থাক না।‘’
‘’ ছাড়
বলিস না। চল টাটা।‘’ ‘
‘’ তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখব জয়ী!’’
‘’ না,
একদম না। তুই জানিস…’’
জয়ীকে
থামিয়ে বললাম, ‘’ সব জানি! কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া ভাল থাকব না।‘’
‘’ ধুর
বাল! তুই যা তো। সেই একই কথা। একই ন্যাকামি। কতবার বলব ওসব ভুলে যা। সেই বাচ্চাদের
মতো নাটক করছিস।‘’ একটু থেমে বললাম, ‘’ নাটক ? ওটা তো তোমার থেকে শিখেছি।‘’ ‘’ বাজে
বলিস না! আমি কোনওদিনও নাটক করেনি।‘’ ‘’ তাহলে একবার বলো ভালবেসেছিলে।‘’ জয়ী বলল,
‘’ চল টাটা! পরে কথা হবে। ‘’
এখন
রাত নামলেই বুকের মধ্যে কতগুলো ব্যথা একসঙ্গে জটলা পাকায়। ঘুমোতে দেয় না। শুধু একটা কথা
বারবার মনে করিয়ে দেয়, ‘ যখন এসেছিলে, তখন কেন এসেছিলে ?’ জানি না কেন এতটা জড়িয়ে গিয়েছি, হয়ত সত্যি
ভালবেসেছিলাম বলে! জয়ী আমাদের ভালবাসাটাকে যেমন নষ্ট করেছে, ঠিক তেমনি আমাদের
সম্পর্কটাকে নষ্ট করছে প্রতিদিন। জয়ী ভুলে গিয়েছে ভালবাসার সম্পর্ক বাদে আমাদের
আরও একটা সম্পর্ক আছে...
(১৫)
একটা
নতুন দিন। মৃদুল আজ প্রবল উৎসাহের সঙ্গে সোহাগের বাড়ির দিকে চলেছে। রবিবার তাই আজ
দুজনেরই ছুটি। সঙ্গে আরও বাড়তি পাওনা হল যে তাঁদের সম্পর্কের কথা এখন বৈধ। মানে
তাঁর মা এই সম্পর্কে রাজি। এর চেয়ে বেশি কিছু আর মৃদুলকে খুশি করতে পারবে না। বাসে
সেই উইন্ডো সিটে বসে মৃদুল তাঁদের সেই আলাপের কথা ভাবতে থাকল। সেই সুখের সময় যা
তাঁর জীবনটাকে প্রায় বদলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে দেখার দৃষ্টি।
কিন্তু
সোহাগের বাড়ি পৌঁছাতেই সবটা কেমন বদলে গেলে। মৃদুল দেখল সোহাগের বর মিছিলের সঙ্গে
খেলা করছে আর সোহাগ একপাশে চুপ করে বসে আছে। এই দৃশ্যটায় মৃদুলকে কেমন নাড়িয়ে দিল।
সোহাগই একবার মৃদুলকে ওর বরের ছবি দেখিয়েছিল। সেই যা দেখা তারপর এই প্রথম একেবারে
সামনাসামনি!
মৃদুল
কী বলবে বুঝতে পারল না। সোহাগের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মৃদুল বুঝতে পারল, সোহাগের
চোখের চোখের কোণে একরাশ জল জমে আছে। এইরকম পরিস্থিতে মৃদুল প্রায় অসহায়। মৃদুলের
কিছু বলার আগেই সোহাগ বলল, ‘’ মৃদুল, ও সুমিত! আমার বর।‘’
‘’
বর মানে? তোমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে!’’ বিস্ময়ের সঙ্গে মৃদুল বলল।
‘’হ্যাঁ,
কিন্তু সুমিত আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, ও বলেছে ও সব অসমাজিক কাজ ছেড়ে দেবে। আমাকে
আর মিছিলকে খুব ভাল রাখবে।‘’
মৃদুলের
পৃথিবীটা কেমন হেলে গেল। সমস্ত সবুজগুলো একনিমেষে কেমন উবে গেল। ‘’ তাহলে আমাদের
সম্পর্কটা ?’’
‘’
মৃদুল বুঝতে শেখ, সব সম্পর্কের পরিণতি হয় না।‘’
‘’
তাহলে এতদিন আমাদের মধ্যে যা হয়েছে...’’ মৃদুল কথাটা শেষ করতে পারল না। সুমিত
এতক্ষণ চুপ করে থাকেলও এবার আর সে বলে উঠল, ‘’ তোমাকে ও বলছে না যে আমি ওর বর,
তাহলে তুমি এত কথা বলছ কী ?’’ মৃদুলের মনে হল একটা কষিয়ে চড় মারি! কিন্তু সে আর
পারল না। মৃদুল বাড়ি থেকো বেরিয়ে এলো একরাশ হতাশা নিয়ে। মৃদুলের কানে একটাই কথা
বারবার বাজতে লাগল, ‘’ মৃদুল বুঝতে শেখ, সব সম্পর্কের পরিণতি হয় না।‘’
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_17.html( তৃতীয় পর্ব)
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_17.html( তৃতীয় পর্ব)
(১৬)
-‘’
কোনওদিন ভালবেসেছিলে?’’
‘’ তুই
এই কথাগুলো বলার জন্য এখানে ডাকলি!’’
‘’ কথা
না ঘুরিয়ে, উত্তর দাও।‘’
‘’ অন্য
প্রশ্ন কর। উত্তর দেব, কিন্তু এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।‘’
‘’ কিন্তু
কেন?’’
‘’ নেই!
কিন্তু কেন নেই জানি না।‘’
‘’ তাহলে
সব মিথ্যে ছিল ?’’
“ আমি
একবারও তো বলিনি সব মিথ্যে ছিল!’’
‘তাহলে
কিছু বলছ না কেন?’’
‘’ কিছু
বলার নেই তাই বলছি না!’’
জয়ী
আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছে। সেই মাতাল করা যৌবন এখন আর নেই। বুকের খাঁজ এখন আর
আকর্ষণ নেই। ঠোঁটের ভাঁজে যে উষ্ণতা ছিল, সেটা আর মিছিল করে না উদাসী দুপুরে। ওর
চোখের চাহনিতে আর সেই স্নিগ্ধতা নেই। টোল পড়া গালে মিলিয়ে গেছে সেই সুখের হাসি।
সাজগোজেও বেশ খামখেয়ালী।
আমি বহুবার জয়ীকে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘’ কী হয়েছে? ‘’ জয়ী
বারবার বলেছে, ‘’ কিছু না।‘’ কিন্তু আমি জানতাম, কিছু হলেও জয়ী আমাকে কিছু বলবে না।
কারণ আমি এখন বাতিলের কথায়। তবে জয়ী আমাকে বন্ধু হওয়ার প্রস্তাব দিলেও, আমি তাতে
কান দিইনি। আমি জানতাম আমাদের সম্পর্কে কোনও দিন বন্ধুত্ব হবে না। হয়ত প্রেম হবে
নয়ত ঝগড়া হবে, এই বাইরে কিছু সম্ভব নয়।
জয়ী আমাকে বলেছিল, ‘’ আমরা একটা অসম্ভবের
দিকে এগোচ্ছি। যেটা খুব ভুল । আমি দু- নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারি না। ‘’ আমি জয়ীকে
উত্তর দিয়েছিলাম, ‘’ আমি তোমাকে পাব না জেনেও ভালবেসেছি। শুধু আমাকে এড়িয়ে যেও না।
আমার কষ্ট হয় । এইভাবেই সারাজীবন আমরা গোপনেই থেকে যাব। সব পরীক্ষার যেমন ফলাফল
নেই, ঠিক তেমন সব প্রেমের ভবিষ্যৎ নেই।‘’
(১৭)
এখনও
আমার আর মৃদুলের কানে সেই কথাটা বারবার বাজে, ‘’ সব প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ নেই,সব
সম্পর্কের পরিণতি হয় না।‘’ এখন আমরা দুজনেই উদাসী হয়েই ভাবি যখন এসেছিলে, তখন কেন
এসেছিলে ? শুধুমাত্র প্রয়োজন নাকি অন্য কিছু। এখনও আমরা সেই শৈশবটাকে আঁকড়ে ধরে
ঘুমিয়ে পরি। সেই উঠোনটা এখনও আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে কোনও ঝড়ের সন্ধ্যেতে। এখনও
সেই সিঁড়িতে আমরা একা বসে ভাবি, আমরা কি পুতুল ছিলাম? নাকি ওদের খেলাঘরের সঙ্গী
ছিলাম ?
কথাটা
শেষ করার আগেই সোহাগ সজোরে চড় মারল মৃদুলের গালে। সোহাগের চোখ এখনও রাগে ছলছল
করছে। সারা শরীরে একটা ভূমিকম্প ছড়িয়ে পরেছে। ফর্সা মেয়েটা হঠাৎই রাগে কেমন লাল
হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে জয়ী
বলল, ‘’ এবার আসি। দুঃখ পাস না। সারাজীবন আমি তোর ভালই চাইব।‘’
মৃদুল
এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। ছাদের
একদিকটা পোস্টের আলোয় আলকিত। বাকি অংশটা আলো-আঁধারিতে। এমন শীতের সন্ধ্যে বেলায়
পরিবেশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে। কেমন গরম করছে।
জয়ীর
চোখ তখন ছলছল করছে। চারিদিক বড্ড অন্ধকার হয়ে এলো। জয়ী হারিয়ে গেল। আমাদের
প্রেমটাও কোথায় উবে গেল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন