বিভোর
আদিত্য ঘোষ
দ্বিতীয় পর্ব
(৫)
মৃদুলের
বাড়ি যাদবপুরের এইট-বি ব্যাস স্ট্যান্ডের কাছে একটা বস্তিতে। তাঁদের অবস্থার উন্নিত
হলেও অন্য জায়গায় বাড়ি করার সামর্থ্য এখনও হয়নি। তবে মৃদুল শোভাবাজারের দিকে একটা বাড়ি
ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁর আর এই বস্তিতে থাকতে ভাল লাগে না। প্রতিদিন একটা
করে অশান্তি, মাতালদের মারপিট, গালাগাল, গুলির শব্দ, আগুন যেন মৃদুলের জীবনের দম বন্ধ
করে দেয়। ছোট থেকে এইসব দেখে মৃদুলের বড় হওয়া, তাই এখন আর ভাল লাগে না। যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব এই জঞ্জাল থেকে বেরোতে চাইছে মৃদুল।
ঠিক সকাল পৌনে ন’টার বাস ধরে অফিসে যায় মৃদুল। ফিরতে
ফিরতে প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। সারাদিন অফিসে এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে চিঠি দেওয়া- নেওয়া,
ব্যাঙ্কে যাওয়া, ফাইল গুছিয়ে রাখা এই করেই দিন কাটে। তারপর বাড়ি ফিরে একটু মায়ের সঙ্গে
গল্প আর বাড়ির দৈনন্দিক কাজ করতে করতে আবার পরের দিন চলে আসে। কিছুদিন আগে অবধি এমনই
নিরামিষ জীবন ছিল মৃদুলের। হঠাৎই একটা দমকা হওয়া যেন সবকিছু পাল্টে দিল, সব কেমন বদলে
দিল।
সোহাগের
সঙ্গে মৃদুলের আলাপ হয় বাসে। যদিও সেটা খুবই কালতালীয়। বিবাহিত একটা মেয়ের সঙ্গে বাসে
আলাপ হওয়া এবং তার পর প্রেম, সবটাই অনেকটা সিনেমার মতো।
সেদিন
মৃদুল উইন্ডো সিট পেয়েছিল। তবে সপ্তাহের শনি- রবি ছাড়া উইন্ডো সিট পাওয়া বেশ ভাগ্যের
ব্যাপার। বালিগঞ্জ ছাড়তেই মৃদুল লক্ষ্য করল,
তাঁর পাশেই মাঝবয়সী একটি মেয়ে এসে বসল। নীলচে চুড়িদার পরা সেই মেয়েটির সারা গা দিয়ে
একটা অদ্ভুত সুগন্ধ বেরোচ্ছে। মৃদুল একবার চেয়ে দেখল মেয়েটার দিকে। সিঁথিতে সিঁদুর,
কপালে একটা ছোট্ট টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে একটা গোলাপি আভা, টোল পরা গালে লেগে আছে উষ্ণতা।
বক্ষদ্বয় বেশ ভরাট এবং তারপর বাকিটা কল্পনা করে নেওয়া যায়।
মৃদুলের
আগে কোনওদিন এমন হয়নি। মেয়েটাকে দেখেই মৃদুল মনে মনে ছটফট করতে শুরু করল। মেয়েটার সঙ্গে
কথা বলতে ইচ্ছে করছে, নাম, ঠিকানা জানতে ইচ্ছে করছে। আগে কোনওদিনও এমনটা হয়নি। মৃদুল
বুঝতে পারছে না, এমনটা কেন হচ্ছে।
মৃদুল হঠাৎ বলল, ‘’ আপনি কোথায় থাকেন ?’’
মেয়েটি
মৃদুলের কথায় একটু বিস্মিত হয়ে বলল, ‘’ কেন বলুন তো ?’’
‘’মৃদুল
একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘’ না মানে, আপনাকে এ বাসে কোনওদিন দেখিনি তো, তাই জিজ্ঞাসা
করলাম।‘’
‘’ আপনি
কি বাসের সবাইকেই প্রত্যেকদিন দেখেন নাকি তাঁদের সবাইকে চেনেন ?’’ মেয়েটি একটু রেগে
বলল।
‘’ আসলে
আমি এই বাসেই প্রতিদিন যাই তো তাই বললাম...’’
‘’ তাতে
কী হয়েছে?’’ মেয়েটি একটু রাগের সঙ্গেই বলল।
মৃদুল
আর কথা বলার সাহস পেল না। তারপর থেকে বাকি পথটা একেবারে চুপ। মৃদুল লক্ষ্য করল, মেয়েটা
এখনও রেগে আছে। যদিও সে মনে মনে ভাবল তাঁর এই বোকামির জন্য একবার সরি বলতে কিন্তু আর
সাহস পেল না। সারাদিন অফিসেও কাজে মন বাসতে পারল না মৃদুল। বাড়ি এসেও মনটা কেমন ছটফট
করতে লাগল, মনে মনে ভাবল, ‘’ দিনটা বড্ড বাজে ছিল।‘’
(৬)
‘’ কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’’
‘’ বরের
সঙ্গে!’’
‘’ প্রায়
আধ-ঘণ্টা ধরে ফোনটা ব্যস্ত বলছিল।‘’
‘’ হ্যাঁ,
কিছু ব্যক্তিগত কথা বলছিলাম।‘’
‘’ বরকে
ছেড়ে থাকতে ভাল লাগছে?’’
‘’ একদমই
না! কবে চলে যেতে পারব ভাবছি।‘’
‘’ আমাকে
ছেড়ে চলে যাবে ?’’
‘’ যেতেই
হবে, কাউকে কথা দিয়ে এসেছি।‘’
‘’ আমাকেও
তো কথা দিয়েছিলে, আমার পাশে থাকবে সারাজীবন।‘’
‘’ থাকব
তো, তবে এইভাবে নয়।‘’
দুপুরটা
আজ শান্ত। প্রতিদিনের মতো কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে না। পাশের বাড়িতে ঝগড়াটা আজ অনেক
আগেই থেমে গেছে। জানলা দিয়ে পুকুরটা দেখা যায়। পুকুর পাড়ে কয়েকটা অবাঙালী ছেলেদের আড্ডা
বসেছে। প্রতিদিনের মতো পুকুরের ওপাশের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীয়ের মারপিট চলছে। বাবা-মা
তুলে গালাগাল দিচ্ছে একে অন্যকে। জয়ীর এগুলো একদম পছন্দ নয়। অন্যদিনের মতো জয়ী, গল্পের
বইতে মুখ গুঁজেছে। জানলা দিয়ে একটা হাল্কা আলো এসে পড়ছে জয়ীর মুখের একপাশে। ডান গালের তিলটা
আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।
, ‘’ কর্নেল সমগ্রটা শেষ হয়নি
এখনও?’’
‘’ না!
দেখিস তো সময়ই পায় না। হেঁসেলে সামলাতে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।‘’
‘’ আর
আমি ? তোমার প্রতিদিনের তালিকায় আমি নেই ?’’
‘’ আছিস
তো!’’
‘’ বল,
শুধুমাত্র প্রয়োজনে আছি।‘’
‘’ বাজে
বকিস না!’’
‘’ আবারও
এড়িয়ে যাচ্ছ।‘’
‘’ বেশ
করছি।‘’ জয়ীর ঠোঁটের কোনায় একটা মিচকে হাসির ঝলক দেখতে পেলাম। জয়ীর হাতটা ধরে একটা
চুমু খেলাম। জয়ী হাসল। জয়ী বুঝতে পারল, এবার আমি কী বলব!
‘’ কিছু
বলবি?’’
‘’ আমাকে
ছেড়ে যেও না!’’
‘’ বাচ্চাদের
মতো করিস না। আমাকে ফিরতেই হবে।‘’
‘’ তাহলে
আমার কোনও মূল্য নেই ?’’
‘’ আবার
পাগলামি করছিস!’’
(৭)
আজও
মৃদুল সেই পৌনে ন’টার বাস ধরেছে। কাকতালীয় ভাবে জানলার পাশেই বসার জায়গাও পেয়েছে। কিন্তু
মৃদুলের মনটা বড্ড বিষণ্ণ। বারবার মনে হচ্ছে, গতকালের জন্য সেই মেয়েটার কাছে একবার
সরি বললে হত। রাস্তায় গাড়ির মেলা। সবাই ব্যস্ত। সবাই দৌড়চ্ছে। এই শহরটাকে মাঝেমধ্যে
বড্ড ফ্যাকাসে দেখায়, মনে হয় সব ভালবাসা যেন মরে গেছে।
চিরকালই ক্রাইসিস আমাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে। আমারা শুধু সাময়িক ভাল থাকার উপায় খুঁজেছি। একটা মধ্যবিত্ত জীবনে অনেক কিছু থাকে, যা বাঁচার রসদ খুঁজতে সাহায্য করে। অনেকের জীবনে সেই সাময়িক ভাল থাকাটা অনেক বড় হয়ে উঠে ।অনেক দীর্ঘ হয়ে ওঠে। এইসব ভাবতে ভাবতে মৃদুল হঠাৎ বুঝতে পারল ওর পাশে এসে কেউ একটা বসল।মৃদুল দেখে চমকে গেলো।কালকের সেই মেয়েটা।
‘’ আপনি ?’’
‘’ কেন ?’’
‘’ চমকে গেলেন নাকি ?’’
‘’ না! মানে...’’
‘’ আমতা আমতা করছেন কেন ?’’
‘’ কিছু বলবেন ?’’
‘’ না, মানে ...’’
‘’ বলুন না, ভয় নেই!’’
‘’ না, ভয়ের কিছু নেই।‘’
‘’ তাহলে, মুখটা অমন শুকনো হয়ে গেল কেন ?’’
‘’ না, আপনি...’’
‘’ আরে বলুন তো, কী বলবেন, এত ভয় পেলে হয় নাকি?’’
কথাটা শেষ করেই মেয়েটা হাসিতে লুটোপুটি খেল।
মৃদুল লক্ষ্য করল, মেয়েটার সারা মুখ জুড়ে একটা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পরল।
একটা অনাবিল আনন্দ খেলা করছে ওর সারা শরীর জুড়ে।
আজ সাদা সালোয়ারে নীল পাখি বাসা বেঁধেছে।
কালো টিপের আভা যেন দিনটাকে ভাল করে দিচ্ছে। টোল পরা গালে লেগে আছে উষ্ণতা।
‘’ কী দেখছেন?’’
‘’ আপনাকে ?’’
এই প্রথমবার একে অন্যের চোখের দিকে তাকাল।
হয়ত একে অন্যের মনের কথা পড়ার চেষ্টা করল। হয়ত একে অন্যের বোঝার চেষ্টা করল।
মৃদুল জিজ্ঞাসা করল,
‘’ আপনার নাম কী?’’
মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, ‘’ সোহাগ।‘’
(৮)
জয়ীকে
আজ বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। সাদা আর নীল ছোপের সালোয়ারটায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জয়ী। বক্ষদ্বয়
মোহময়ী। চোখের একপাশে বারবার উড়ে আসা চুল ওকে বিরক্ত করছে। আমি সেই উড়ুক্কু চুল সরিয়ে
জয়ীর গালে একটা চুমু খেলাম।
জয়ী
সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘’ কেউ এসে যাবে!’’ আমি জয়ীর আরও কাছে এসে বললাম,
‘’ কেউ আসবে না।!’’ জয়ী বলল, ‘’ এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।‘’ আমি জয়ীর আরও কাছে গিয়ে
বললাম, ‘’ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।‘’
জয়ী আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। একটা
অব্যক্ত রাগ দেখতে পেলাম জয়ীর চোখে। জয়ীর কপাল জুড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন চিন্তার
ভাঁজ। আমি সেই চিন্তার ভাঁজে ছুঁয়ে দিলাম আমার সিক্ত ঠোঁট। জয়ী আমার আরও কাছে চলে এলো।
ওর চোখ দুটোই দিলাম আশ্বাসের স্বাদ, জয়ী আমার বুকে মাথা দিল। তারপর গালে, ঠোঁটে ছুঁয়ে
দিলাম আমাদের ভালবাসা। আরও জাপটে ধরলাম ওকে।
গলা বেয়ে বুকের খাঁজে দাঁড়ালাম।
জয়ী
আমাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল। তারপর অনেক্ষন নিস্তব্ধতা। দুপুর প্রায় শেষের পথে। জয়ী বলল, ‘আমাকে ভুলে
যা!’’ আমার পৃথিবীটা কেমন হেলে গেল। বললাম, ‘’ কেন?তুমি ছাড়া তো আমি অন্ধকার!’’
জয়ী
একটু ধমকের সঙ্গে উত্তর দিল, ‘’ কাব্য ছাড়! আমি তোকে ভালবাসতে পারলেও সেটা কোনওদিন
স্বীকার করতে পারব না। কারণ আমি অন্য কারুর। তাঁর জন্যই বাঁচতে হবে, তাঁর জন্যই
ভালবাসতে হবে।‘’ আমি বললাম, ‘’ তুমি কেমন বুড়িদের মতো কথা বলছ!’’ জয়ী আবার বলল, ‘
যা বলছি, একদম ঠিক বলছি। আমি তোর ভাল চাইব সারাজীবন, যেখানেই থাকি আমরা খুব
কাছাকাছি থাকব।‘' ( পরবর্তী অংশ আগামী সপ্তাহে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন