কবি, কবিতা এবং স্বাধীনতা - সুচন্দ্রা সিংহ
বাংলায় একটা বহুপ্রচলিত প্রবাদ রয়েছে - "নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?" যার সরলীকরণ করলে বোঝা যায়, গোঁড়ামিও আগুনের মতই ছোঁয়াচে। এবং দুটোই সমানভাবে ধংসাত্মক। সম্প্রতি, সেই প্রবাদেরই বাস্তবায়ন দেখল পশ্চিমবঙ্গ। ভারতের ডেমোক্রেসি' এবং ''রাইটস'' আজও মিলতে পারল না এক বিন্দুতে, সমান্তরাল হয়েই থেকে গেল এতকাল।
বিষয়, শ্রীজাত। শিল্পী হিসেবে, কবি হিসেবে, বাকস্বাধীনতা আমাদের কাম্য। শব্দ দিয়ে শুধু প্রেয়সীকে ছোঁয়াই নয়, শব্দের আঘাতে জব্দ করতে হয় (অ)সামাজিক প্রথাদের। শব্দের তুলিতে অনুভূতিকে আদর মাখানোই নয়, শব্দের চাবুকের দাগ বসাতে হয় ভেদাভেদ-হিংসা-দর্পের বুকে। তাতেই কলমের জয়, তাতেই জনসাধারণের কাছে নিজের কথা ব্যক্ত করার ক্ষমতা। একটি মানুষও যদি নিজের খারাপ মত পাল্টায় কোনো লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে, সেটাই তবে লেখকের প্রাপ্তি। এবার আসি মূল কথায়। শ্রীজাতর বিতর্কিত লেখাটির পংক্তি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত।
বহুদিনই তা নানাভাবে নেগেটিভ পাবলিসিটি পেয়ে এসেছে। লেখাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে নানান ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কথা শুনতে হয়েছে তার সমর্থকদেরও। এমনই এক ঘটনার সাক্ষী থাকল অসমের শিলচরও। "এসো বলি" নামক এক সংস্থার আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আবারও আক্রমণ করা হল শ্রীজাতকে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কিছু মানুষ এসে বিক্ষোভ দেখালেন। দাবী করলেন, সেই 'কু'খ্যাত পংক্তির অর্থ বোঝাতে হবে। শুরু হল কথা কাটাকাটি। এই বিশ্রী ব্যাপারে প্রতিবাদে কাল কলকাতায় এক সুদীর্ঘ মিছিলে হাঁটল বহু মানুষ। এই পর্যন্ত ঘটনা তো সকলেরই জানা।
এবার প্রশ্নটা হল, শিল্প কি শুধুই প্রেম-বিচ্ছেদ-যৌনতায় বন্দি হয়ে থেকে যাবে চিরকাল? কষাঘাত হানতে পারবে না সমাজের গায়ে? গোঁড়ামীই প্রাধান্য পাবে সর্বক্ষেত্রে? ধর্ম-জাতের ভেদাভেদ আরো প্রকট করে তুলবে সবাই? একদল মানুষ শুধুমাত্র গায়ের জোরে, বুঝে অথবা না বুঝে দমিয়ে দেবে রুখে ওঠা আওয়াজগুলোকে? অর্থহীন হয়ে যাবে লিবার্টি, ডেমোক্রেসি, ফ্রীডম অফ স্পীচ এর মত কথারা? সত্যিই ধর্মের মুখোশের আড়ালে অধর্মের খেলা চলবে এখানে? কেউ গলা তুলে জিজ্ঞেস করবেনা "রাজা তোর কাপড় কোথায়?" কেউ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবেনা "কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়?" সুর-কথা-রঙ সব থমকে যাবে বিরোধিতা-আক্রোশ-বিক্ষোভের ভয়ে?
উত্তরটা অজানা। প্রশ্নটা রইল আপনাদের জন্য। এরপর একদিন হয়তো চিরাচরিত কথা বলতেও দু'বার ভাবতে হবে আমাদের। পাশবিক সমাজে পশুর মতই অবলা মূক-বধির হয়ে থেকে যেতে হবে শত্রুতা এড়াতে। তাই ভেবে দেখবেন। স্রোতে ভাসতে গিয়ে নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের অধিকার খর্ব করছেন না তো এই আধুনিক এর যুগে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন