অ স্থা ব র
দ্বিতীয় পর্ব
আদিত্য ঘোষ
আমাকে কেউ বলেছিল, ‘’ ভালবেসে কাঙাল হতে চাই না!’’ আমি তখন মনে মনে ভেবেছিলাম,
‘’ ভালবাসলে তো একদিন না একদিন তোমাকে কাঙাল হতেই হবে।‘’ যতই পজিটিভ হোক আমাদের সম্পর্ক,
যতই সখ্যতা থাক আমাদের মধ্যে কিন্তু এমন কোনও পরিস্থিতি আসবে না তো কোনওদিন যা আমাদের
আরও দূরে নিয়ে যাবে, এই ভেবে এখনও ভয় হয়। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এখনও শীতের দুপুরে্......
তখন জুন মাসের শেষের দিক। বাড়িতে তখন সাজসাজ রব। এই বাড়িতে প্রথমবার কোনও বিয়ের
অনুষ্ঠানকে উপভোগ করতে পারব এই ভেবে আনন্দ হচ্ছে। আমার মনে পড়ে না এর আগে এই বাড়িতে কোনও
বিয়ে দেখেছি কিনা! আমি তখন ক্লাস টুয়েলভে। পরের বছরেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, যদিও
তখনও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমিই আমাদের পরিবারের মধ্যে একমাত্র যে
কিনা একটু ট্যারাব্যাকা! মানে, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও রীতিমতো সাহিত্য চর্চায় মেতে
থাকি। যদিও গর্বের ব্যাপার নয়, অনেকেই এটা নিয়ে প্যাঁক দেয়! তবে ওসব আমার গায়ে
লাগে না। হাল্কা হেসে উড়িয়ে দিই। আমাদের পরিবারে বেশিভাগই সরকারী চাকরি করে কিংবা
করত আর কেউ কেউ ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত তবে কেউই সাহিত্যের সঙ্গে
যুক্ত নেই অথবা সেইটাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। আমি একমাত্র বীরপুরুষ যে এই অনিশ্চয়তার
দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! ভাবলে নিজেরই কেমন হাসি পায়।
আমাদের তিন পরিবারের
মধ্যে তখন সদ্য সদ্য সখ্যতা গড়ে উঠছে। যদিও তার কারণ দাদার বিয়ে,মানে জ্যেঠুর
ছেলের। তবুও একটা ক্ষীণ দূরত্ব আমাদের মধ্যে ছিল। আসলে একযুগ কথা বন্ধ থাকার পর কেউই অতটা
মসৃণ হতে পারে না, আমরাও পারিনি। তবুও ওটাই সম্পর্কের শুরু।
আমার জীবনে এমন সম্পর্ক এসেছে, যেখানে প্রতিদিন ঝগড়া হত। প্রায় কথা বন্ধ হওয়ার
পর্যায়ে চলে যেত। এমন কী কতবার কথা বন্ধ হয়েও গেছিল। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখেছি,
ঝগড়ার পর কিন্তু প্রেমটা আরও বেড়ে যায়। যদিও আমাদের প্রেমটা খুবই আপেক্ষিক ছিল
তবুও এটা বারবার দেখেছি ঝগড়ার পর টানটা আরও বেড়ে যায়, আরও এক অন্যের কাছে আসতে
ইচ্ছে করে। আমাদের পরিবারের মধ্যেও এই ব্যাপারটা হয়েছিল। আমাদের টানটা হঠাৎই বেড়ে
গিয়েছিল। আমরা এক হয়ে যাচ্ছিলাম।
তখন স্কুলে যাওয়ার এত হিরিক ছিল না! একেই
স্কুল জীবনের শেষ দিক, তবুও খুবই কম স্কুলে যেতে হত। কিছুটা স্যারেরাই বারণ করত। তাঁরা
বলত, ‘’ বাড়িতে বসে পড়াশুনা কর। ‘’ আমি ঠিক উল্টোটা করতাম। তখন সদ্য সদ্য সিগারেট খাওয়া
ধরেছি। মানে ঐ বয়সে একটু পাখনা গজিয়েছে। এদিক-অদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি, নাটক দেখছি, কবিতা
পড়ছি ব্যস, এই করে কেটে যেত। তার মধ্যে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান, বেশ মজায় ছিলাম।
আমি দাদার সঙ্গে বরযাত্রী গেছিলাম, একেবারে সামনের সিটে বসে। এখন মনে আছে তার আগে
স্করপিও গাড়িতে জীবনেও ওঠা হয়নি, ওটাই প্রথম। তারপর যাচ্ছি আবার সল্টলেক। একেবারে বুকের
ছাতি ফুলেফেঁপে বিয়াল্লিশ হয়ে গেছে। হয়ত ওটাই
প্রথম সল্টলেক যাওয়া!
কথায় বলে বাঙালীরা কলকাতার বাইরে গেলেই নাকি তাঁদের বয়স কমে যায়, ঠিক তেমনি মফস্বলের
লোকেরা কলকাতায় গেলে তাঁরাও একটু পাল্টে যায়। আসলে ঐ বয়সে ওটাই স্বাভাবিক ছিল। ঐ ভাবনাগুলো তখন ভিড় করত। এখন বুঝি
হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেলাম।
গাড়িতে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কোনওদিন ভাবতেই পারিনি যে দাদার সঙ্গে বরযাত্রী
যাব। তখনও বুফে সিস্টেমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আসলে মফস্বলের বিয়েতে এখনও বসিয়ে
খাওয়ানোর রীতি আছে। আর তখন তো কলকাতা শহরটা একেবারে আমার কাছে গল্পের মতো। শুধু
তাই নয়, অনেক রীতিনীতিই আলাদা, ব্যবহার আলাদা, সবকিছুই একটু অন্যরকম।
তবে বিয়েটা উপভোগ করেছিলাম। আরও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, বাড়ির নতুন
অতিথি কখন বাড়ি আসবে। আসলে ছোট থেকে ঐ মানুষদের দেখে বড় হয়েছি, এদের বাইরে কেউই
বাড়ির লোক হয়ে আসেনি। এই প্রথম, আমার দেখা এটাই প্রথম। তাই আগ্রহ ছিল।
কিন্তু আমরা যা চাই সেটা সবসময় পাই কি? আমাদের কপালে কী লেখা আছে, সেটাও পড়তে পারে কি কেউ? আমরা জানি না ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা
করছে! আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ছিল সেই দিনটা।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাড়িতে এল আমাদের নতুন লোক! মুখে তার সবসময় হাসির ঝিলিক
লেগে আছে। তার কিছুক্ষণ পরেই গোটা আনন্দটা হঠাৎই নিভে গেল। ঠাকুমার মৃত্যু হল,মানে
আমার জ্যেঠুর মা। এইরকম একটা মৃত্যু সবকিছু বদলে দিল। যদিও তাঁর বয়স হয়েছিল,
কিন্তু এমন একটা দিনে তাঁর মৃত্যু আমাদের থমকে দিয়েছিল।
যে প্যান্ডেলটা বিয়ের জন্য করা হয়েছিল, সেটাই শ্রাদ্ধের জন্য ব্যবহার করা
হয়েছিল। দাদা যতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল, সেই ছুটি আরও দীর্ঘ হল। বাতিল হল বৌভাত।
বাতিল হল সব আনন্দ। যারা এসেছিল, তারাও ফিরে গেল একরাশ দুঃখ রেখে। আর রেখে গেল
একটা প্যান্ডেল, বাড়ি আর আমাদের নতুন অতিথিকে।
কিন্তু শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান হওয়ার
আগে অবধি যে সময়টা আমাদের ছিল, সেটাই হয়ত আমাদের পরিবারের সেরা সময় ছিল । একে
অপরের দুঃখের যেমন ভাগীদার হতে পারে তেমনি আনন্দের। আমরাও সেই সময় আমাদের সময়গুলো
ভাগ করে নিয়েছিলাম। মাঝে কিছুদিন এদিক-অদিক ঘুরতেও গেছিলাম। আমি, দাদা, বৌদি আরও
অনেকে তখন ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়া ঘুরতে গেছিলাম। যদিও আমাদের বাড়ি থেকে কিন্তু
দূর নয়। রামঘাট পেরোলেই ইমামবাড়া। রামঘাটে নৌকার ব্যবস্থা থাকায় গরিফা-হুগলী যাওয়া
খুব সহজ।
আমাদের দিনগুলো এমনই করে কেটে গেল। আমরা আরও কাছাকাছি চলে এলাম। সব ঝগড়ার ইতি
হল। এখন এখানে সারাদিন রোদ্দুর খেলা করে। সকাল সাতটা বাজলে সব ঘরেই একসঙ্গে রেডিও
বাজে। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যে হলে প্রত্যেকটা ঘরে একই সিরিয়াল চলে। আমরা এখন ইউনিটি
ইন ডাইভারসিটি হয়ে বেঁচে আছি।
আমরা এখন আর ঝগড়া করি না! আমাদের মধ্যে কথা বন্ধ। যদিও মাঝে মাঝে মেসেজ আসে।
কতগুলো ডট, কতগুলো স্মাইলি। কিন্তু আমি কোনও উত্তর দিই না। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এখনও শীতের
দুপুরে......
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন