বিভোর
আদিত্য ঘোষ
তৃতীয় পর্ব
(৯)
“ অমন করে কী দেখছ ?’’
‘’ তোমাকে!’’
‘’ শুধুই কী দেখবে ?’’
‘’ তাহলে ?’’
সোহাগ
মৃদুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘’ এমন ভাবেই সারাটা জীবন আমার পাশে থাকবে কথা দাও।‘’
‘’ কথা দিলাম এইভাবেই তোমাকে জড়িয়ে থাকব
সারাজীবন।‘’ মৃদুল সোহাগকে জড়িয়ে ধরে যেন অনেক শান্তি
খুঁজে পেল।
সেদিনের
সেই মেয়েটা এখন মৃদুলের সর্বক্ষণের সঙ্গী। প্রতিদিনের
একসঙ্গে বাস জার্নিটা ওদের পেয়ে বসল। ওদের আলাপ জমে উঠল। একে অন্যকে চিনতে শুরু
করল। একে অপরের ভরসা হয়ে উঠল। ব্যস, তারপর বাকিটা অনেকটা গল্পের মতো।
সোহাগ
একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপি রাইটারের কাজ করে। ছোট থেকে উত্তর কলকাতার অভিজাত
পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। গান, কবিতা, আবৃত্তি, নাটক এইসব বিষয়ে সোহাগের আগ্রহ বেশি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছে। তারপর থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন
সংস্থায় কাজ করছে।
পাঁচ
বছর হল সোহাগের বিয়েও হয়েছে। একটা দু-বছরের ছেলে আছে। যদিও সোহাগের বিয়েটা বাড়ির
মতেই হয়েছে, দেখাশুনা করে। কিন্তু সোহাগের এই বিয়েতে একটুকুও মত ছিল না।
তবে বাড়ির
বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কিছু করার ক্ষমতা সোহাগের ছিল না। সে চেয়েছিল নিজের পায়ে
দাঁড়াতে, নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করতে। কিন্তু আমরা যা চাই সেটা কী আমরা সব সময় পাই ?
বিয়ের
পর থেকেই সোহাগ বুঝতে পারে, ছেলেটা বিভিন্ন অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। যখন বিয়ের
ব্যাপারে কথা হয়, তখন ছেলের বাড়ির লোক জানিয়েছিল যে তাঁদের পৈতৃক সোনার ব্যবসা
আছে।
শুধু কলকাতায় নয়, কলকাতায় বাইরেও তাঁদের সোনার কারবারি আছে। দেখেশুনে তাঁদের
যথেষ্ট ভাল বলেই মনে হেয়েছিল। ধুমধাম করে তাঁদের বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরই
সোহাগ বুঝেছিল, তাঁদের পুরো পরিবারটাই বিভিন্ন অসমাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। শুধু
তাই নয়, এই বিয়েটাও বেশিদিন টিকবে না।
এমনিও
দিন গেছে বরের হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছ সোহাগ। ছেলেটা কোনওদিনই চাইনি সন্তান নিতে
কিন্তু সোহাগের জোড়ের কাছে ছেলেটা হেরে গিয়েছিল। তবে সন্তান হওয়ার পর সোহাগের ওপর
অত্যাচার আরও বেড়েছিল। এমনকী, সোহাগ যে বাইরে চাকরি করতে যাবে সেটাও তাঁর শ্বশুরবাড়ির অপছন্দের বিষয়। বড্ড রক্ষণশীল
পরিবার। সোহাগের ওপর যে তাঁর স্বামী অত্যাচার করত, সেই নিয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ি
চিরকালই নিরুত্তাপ ছিল। এমনও দিন গেছে সোহাগকে একঘরে বন্দী করে রেখেছে, কিচ্ছু
খেতেও দেইনি। কিন্তু সোহাগ তাঁর বাড়িতে জানায়নি, সে জানে বাড়িতে জানালেই তাঁর
মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই সে ঠিকই করে নিয়েছিল, যা করতে হবে একাই করবে। সেই
থেকেই সোহাগের একাই পথ চলা।
(১০)
বাড়িটা
এখন প্রায় খালি। সমস্ত কোলাহল উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে ঝগড়া। নোংরা ফেলার গাড়িটা এখনও বাঁশি বাজায়
সকালে, কিন্তু কোথাও যেন হারিয়ে গেছে সেই ব্যস্ততা। পাশের বাড়ির দম্পতিও হঠাৎ চুপ হয়ে গেছে। গলিতে আর অবাঙালী ছেলেদের আড্ডা বসে
না। কৌশিকের বাড়ির ছাদ থেকে যে কদম গাছটা
দেখা যেত, যেখানে রাত হলেই ভিড় করত জোনাকির দল, তারাও আজ নিরুদ্দেশে।
যে উঠোনে আমরা সময় পেলেই একে অন্যকে
একটু ছুঁয়ে দেখতাম, সেই উঠোনও আজ শান্ত
হয়ে গেছে। দুপুরে যে কাকটা এসে বারবার ডাকত, সেও আজ কোথায় পালিয়ে গেছে। পাল্টে গেছে আমার রোজনামচা। সাপ্তাহিক সাতকাহনে বয়স বেড়েছে সেই
ছোট্ট মেয়েটার, যে আগে সারাদিন দৌড়ে বেড়াত এই উঠোনে। হ্যাঁ, প্রেমের মাস। বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় সময়।
আগের
বছরও ঠিক এই সময়ে যার জন্য মন ব্যাকুল থাকত, এখন সে এই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। শুধু রেখে গেছে তার গন্ধ। যেটা প্রতিদিন আমাকে বলে, ‘’ভালবাসা কোনওদিন শেষ হয় না। ওটা বেঁচে থাকে অন্য কোনও ভাবে।‘’
জয়ী, আমরা কোনওদিনই কোনও অসম্ভবের দিকে এগোয়নি। আমরা একে অন্যকে পাবো না জেনেও ভালবেসেছি। এটার চেয়ে বড়ো আর কিছু হতে পারে না। আমরা তো চিরকালই আপেক্ষিক ছিলাম,
লুকিয়ে ছিলাম। হয়ত এইভাবেই থাকব সারাজীবন। জয়ী, আমাদের মতো কত প্রেম এইভাবে বেঁচে
থাকবে, কে জানে! কে জানে, একদিন হয়ত আমরা তাদের আদর্শ হয়ে উঠব।
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_12.html ( দ্বিতীয় পর্ব)
https://atpoureblog.blogspot.com/2019/01/blog-post_12.html ( দ্বিতীয় পর্ব)
জানো,
তুমি যখন এড়িয়ে যাও তখন বড্ড কষ্ট হয়। তোমাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাইনি।
তুমি আরও এড়িয়ে গেছো। কোনওদিন কোনও ভালবাসা
শেষ করতে হলে, মুখের ওপর বলবে। এইভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা কোনও সমস্যার সমাধান নয়। আর
আমাকে যদি তোমার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিতে চাও তাহলে বলব এমনিতেই আমরা উনিশ হাজার
তিনশো বাইশ কিলোমিটার দূরে থাকি, আর কত দূরে যেতে চাও?
(১১)
মৃদুল
বরাবরই সোজাসাপটা। প্রেম-ভালবাসার ঝলকটুকুও ছেলেবেলায় পাইনি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ভাল
থাকা এবং তাঁর মাকে ভাল রাখা। চারবেলা পেটপুরে খেতে পারলেই হল। ব্যস, এর বাইরে মৃদুল কিচ্ছু চাইনি কখনও। কিন্তু
যেদিন থেকে সোহাগের সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছে, ও নিজেকে কেমন বদলে যেতে দেখছে। কেমন খামখেয়ালী হয়ে যাচ্ছে। কাজে ঠিক মন বসাতে পারে
না।
অফিসে যাওয়ার সময়টা দুজনেই একই বাস ধরে যায়, কিন্তু ফেরার সময় কখনও দেখা হয় আবার
অনেক সময় হয়ও না। সোহাগ যদিও মৃদুলের অনেকটা পরেই অফিস থেকে ফেরে, তবুও মাঝে মধ্যে
মৃদুলই সোহাগের জন্য অপেক্ষা করে।
এখন সোহাগ দক্ষিণ কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট
ভাড়া নিয়ে থাকে। প্রায় এক বছর হয়ে গেলো ওদের ডিভোর্স হয়েছে। ছেলেটা যদিও সোহাগের সঙ্গেই
থাকে। ইচ্ছে করলে সোহাগ নিজের মা-বাবার কাছে চলে যেতে পারত, কিন্তু যাইনি। সোহাগ জানে
উত্তর কলকাতাটা এখনও বাইরে থেকেই আধুনিক, ভিতরে ভিতরে সব আগের মতোই আছে। সোহাগের মা-বাবা সবটাই জানে, কিন্তু ওরা কিছু বলে
না। শুধু একটাই কথা বলেছে, ‘’ বিয়ের পর ডিভোর্স করে এইখানে আর ফিরে এসো না।‘’ তাই সোহাগ আর ওমুখ হয়নি।
জীবনে একবারই সোহাগের জীবনে প্রেম এসেছিল, সেটাও কলেজে পরার
সময়। কিন্তু সেটা ওখানেই শেষ হয়ে গেছিল। তারপর আর কোনওদিন প্রেমের ছোঁয়া পাইনি
সোহাগ। কিন্তু কেন যে মৃদুলকে হঠাৎ ভাল লেগে গেল, সেটাও সোহাগ জানে না। শুধু সোহাগ
নয়, মৃদুলও জানে না। দুজনের মধ্যে বয়সের ফারাকও রয়েছে প্রায় বছর পাঁচ। সোহাগ বয়সে
বড়। এছাড়াও দুজনের মধ্যে প্রচুর অমিল। কিন্তু তাও একে অন্যকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছে।
আসলে আমরা কেন যে একজনকে ভালবেসে ফেলি তার উত্তর কোনওদিন
খুঁজে পাই না।
মৃদুল
সোহাগের সঙ্গে ওর ফ্ল্যাটে গেছে। সোহাগের ছেলেটার সঙ্গেও মৃদুল বেশ আলাপ জমিয়ে
ফেলেছে। ওর নাম মিছিল। বেশ ফুটফুটে দেখতে। সোহাগের মতো চোখের গঠন। বেশ আদুরে। সবে মাত্র হাঁটতে
শিখেছে। মৃদুল সুযোগ পেলেই সোহাগের সঙ্গে সময় কাটায়, ওর ফ্ল্যাটে যায়। মিছিলের
সঙ্গে খেলা করে।এমনি করেই মৃদুলের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।
আমরা যখন একে অপরকে
ভালবাসতে শুরু করি তখন একে অন্যের প্রিয় জিনিসগুলোর প্রতিও ভালবাসা চলে আসে। এটাই
হয়ত স্বাভাবিক, এটাই হয়ত নিয়ম।
(১২)
জয়ী
তখন অনেক পরিণত। যৌবন শেষ হওয়ার আগে আরও একবার জেগে উঠেছে। ভরাট বুক। ঠোঁটের কোনার
ছোট্ট তিলটা আমাকে আরও প্রশয় দিত। নরম হাতে যখন আমাকে ছুঁত, মনে হয় শিরায় শিরায় বিপ্লব
শুরু হল। নাভির বৃত্তটা আমার মাথার মধ্যে ঘূর্ণির সৃষ্টি করত। একটা অমসৃণ পিঠের তোলপাড়
হওয়া ঝড় আমাকে এক ঝটকায় ফেলে দিত। তবুও এই সব কিছুর পরেও আমি শুধু জয়ীকে ভালবেসেছিলাম।
ওর শরীরকে নয়। যদিও অনেকে বলেন, শরীর ছাড়া প্রেম হয় না। যদি সেই সূত্র মেনেও নিই তাহলে
আমারা প্রেম করিনি, কারণ আমাদের মধ্যে কোনওদিন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি।
আমরা
বুঝতে পারছিলাম, আমরা একে অন্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমরা একে অন্যের কাছে আসতে
চাইছি।
‘’ আমাদের
সম্পর্কটা কোনওদিনই স্বীকৃতি পাবে না।‘’
‘’ জানি!
আমরা কোনওদিনই এক হতে পারব না।‘’
‘’ কিন্তু
সারাজীবন আমারা একে অন্যের কাছে থাকতে পারি।‘’
‘’পারি
তো!’’
‘’ কিন্তু
জয়ী, এইভাবে নয়।‘’
‘’ মানে?’’
জয়ীকে
এক ঝটকায় টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। সন্ধ্যের পর এই ছাদে এউ আসে না। এইদিকে কোনও লাইটও
নেই। তাই এটাই এখন আমাদের মান-অভিমানের মঞ্চ। ইচ্ছে করছিল জয়ীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে
দিই, কিন্তু পারলাম না। জয়ী ছাড়িয়ে নিল।
‘’ তুই
জানিস আমি বিবাহিত।‘’
‘’ সব
জানি জয়ী, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি ভাল থাকতে পারব না।‘’
‘’ বোকার
মতো কথা বলিস না।‘’
‘’ আমাকে
ছুঁয়ে বল, তুমি আমাকে ভালবাস না ?’’
জয়ী
সেদিন আর কিছু বলেনি। শুধু সেদিন কেন আজও এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে, জয়ী এড়িয়ে যায়।
আমারা জানতাম আমরা কোনওদিন এক হতে পারব না, কিন্তু তাও সেদিন কেউ কাউকে একবারেও জন্যও
আটকায়নি। আমরা এক হতে চাইছিলাম।
একদিন
সন্ধ্যেবেলা আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি, হঠাৎই আমার কাছে একটা অপ্রত্যাশিত ফোন এলো। আমার
স্বপ্নের ডাক। বাংলার সেরা পত্রিকায় ইন্টারভিউ-এর ডাক পেলাম। যদিও খুশিতে বেশ ডগমগ
ছিলাম, কিন্তু যদি না পায় সেই ভয়ও হচ্ছিল। জয়ী আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার হাতটা
ধরে বলেছিল, ‘’ তুই পারবি, দেখিস।‘’ আমি বলেছিলাম, ‘’ যদি চাকরিটা পেয়ে যায়, তাহলে
তোমাকে জয়ী বলে ডাকব।‘’ ও বলেছিল, ‘’ আচ্ছা, তাই বলিস।‘’
তারপর
বাকিটা হয়ত লেখাই ছিল। আমিও চাকরিটা পেয়ে যায়। সেই সাধারণ মেয়েটা তারপর থেকে জয়ী হয়ে
যায় সবার কাছে। ওর আসল পরিচয়টা চিরকালই গোপন থাকবে। কারণ আমি কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু
যতই জয়ীর চলে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছিল, জয়ী ততই আমাকে এড়িয়ে যেত। বুঝতাম না কেন, বহুবার
জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পেতাম না। ফোন ধরত না, মেসেজ করত না এমনকী হাঁটতেও যেত না
বিভিন্ন শারীরিক অজুহাতে। আমার জয়েনিং-এর দিন যতই এগিয়ে আসছিল, জয়ী আমাকে ততই এড়িয়ে
যাচ্ছিল। ( শেষ পর্ব আগামী সপ্তাহে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন