সব চরিত্র কাল্পনিক
আদিত্য ঘোষ
(১)
‘’
সব চরিত্র কাল্পনিক?’’
‘’
হ্যাঁ, কেন? সমস্যা আছে?’’
‘’
আরে সমস্যা কেন থাকবে? মানে নামটা কেমন কেমন লাগছে!’’
‘’
বললেই হয় নামটা বাজে। তোমার পছন্দ নয়। অত নাটক করার কিছু নেই।‘’
‘’
আরে তোমরা মেয়েরা এত ছোট ছোট ব্যাপারে কেন রেগে যাও বলো তো?’’
‘’
রাগ করার মতো কাজ করলে তো রেগে যাবই!’’
‘’
আজব তো! রাগ করার মতোই তো কিছুই করিনি। শুধু বললাম নামটা বেমানান।‘’
‘’
সে তো হবেই! আমি রেখেছি না। তোমার ওই হট প্যান্ট পরা সেক্রেটারি রাখলে তো নাচতে
নাচতে সমর্থন করতে।‘’
‘’
আরে আজব তো! কোন কথা হচ্ছিল আর কোন কথায় চলে গেলে?’’
‘’
কেন ? সেক্রেটারির নাম বললাম বলে রেগে গেলে ? সেটাই তো স্বাভাবিক!’’
‘’
তুমি একটু চুপ করবে প্লিজ ?’’ মিছিল বিরক্ত হয়ে বলল।
পিউ
মুখটা বেঁকিয়ে বলল, ‘’ আমাকে বিয়ে না করে তো ওই ন্যাকাকে বিয়ে করতে পারতে! সে
তোমার বইয়ের জন্য ভাল নাম ঠিক করে দিতে পারত। ‘’
মিছিল
এবার রেগে গিয়ে বলল, ‘’ পিউ, তুমি কি থামবে? নাকি আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব ?’’
পিউও
রেগে গিয়ে বলল, ‘’ আচ্ছা, আমিই চললাম! আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে আসবে
না।‘’
এই ঘরটা মিছিলের কাজের ঘর। প্রতিটা দেওয়ালের রং
আলাদা। প্রতিটা দেওয়ালে একটা করে ছবি আঁকা। কোনটায় পাখির ছবি আবার কোনটায়
ল্যাম্পপোস্টের। শুধু আঁকা ছবি নয়, মিছিলের তোলা ছবিও বাঁধানো আছে। উত্তর কলকাতার
বনেদী বাড়ির ছবি, শান্তিনিকেতনের দোলের ছবি, কৃষ্ণনগরের তাঁতের ছবি, দার্জিলিং-এর
ট্রয়ট্রেন, হিমালয়, রাজস্থানের মরুভূমি এবং আরও অনেক। ঘরের উত্তর- পূর্ব দিকে একটা
বিরাট বইরের র্যাক আছে। সেখানে প্রচুর বই। দেশ-বিদেশের বেশ কিছু অমূল্য বইও
রয়েছে। ফটোগ্রাফির বই, বিজ্ঞাপনের বই, ভ্রমণ এছাড়াও গল্প, উপন্যাস, কবিতা তো আছেই।
মিছিলের টেবিলে একটা ল্যাম্প আছে। পেনদানিতে হরেক রকমের পেন, প্রচুর কাগজ এলোমেলো
ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। একটা ল্যাপটপ
সবসময় সেই টেবিলেই থাকে। ওটা মিছিলের লেখার সঙ্গী। ল্যাপটপের পাশে রাখা সিগারেটের
প্যাকেটটা থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে মিছিল মনে মনে ভাবল, ‘’ নারী চরিত্র বড্ড জটিল!
ওদের বোঝার কোনও উপায় নেই। ’’
পিউ
আর মিছিলের বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর হতে চলল। তার আগে ওদের দু-বছরের প্রেম। মিছিল
একটি বেসরকারি সংস্থায় সেলস ম্যানেজার আর পিউ একটি সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। ওদের
ফেসবুকেই আলাপ। তারপর প্রেম এবং বিয়ে। দুজনই জন্ম সূত্রে কলকাতার বাসিন্দা।
দুজনেরই দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি রয়েছে তবুও ওরা রাজারহাটে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। আসলে ওরা ওদের সময়টাকে পুরো ভাগ
করে নিতে চাই, ওরা একে অন্যকে আরও ভাল করে বুঝতে চাই।
ছোট থেকে মিছিলের সাহিত্যের
প্রতি একটা টান রয়েছে। যেটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে সেই সময়টা মিছিল লেখালেখি,
ফটোগ্রাফি, বই পড়া এগুলো নিয়ে মেতে থাকে। সদ্য মিছিলের প্রথম বই প্রকাশ হতে চলেছে।
সবই প্রায় ঠিকঠাক আছে কিন্তু ওই বইয়ের নামটা নিয়ে একটু টালবাহানা চলছে। বেশ কয়েকটা নাম ঠিক হয়েছিল, কিন্তু মিছিল প্রায়
সবগুলোই বাতিল করে দিয়েছে। প্রকাশকও বেশ কয়েকটা নাম বলেছিল, কিন্তু তাও বাতিলের খাতায়।
এর আগে
মিছিল কয়েকটা পত্র পত্রিকায় লিখেছে। বেশ কিছু অনলাইন সাইটেও মিছিলের লেখা প্রশংসা পেয়েছে।
তবে সেগুলো সবই ভ্রমণের ওপর। এই প্রথম মিছিল
একটা উপন্যাস লিখেছে। তাও সেটা বই আকারে প্রকাশ হবে। সেটাও আবার একটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে।
তাই মিছিল একটু চিন্তিত। আসলে পুরো ঘটনাটা মিছিল নিজে শুনেছে। গল্পের প্রত্যেকটা
চরিত্র বাস্তবে আছে। বহুদিন ধরে মিছিল এই উপন্যাসটা লিখেছে। উপন্যাসের স্বার্থে
অনেক কিছু গোপন করেছে। তাই মিছিলের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। উপন্যাসের নামটা
নিয়েও মিছিল বেশ চিন্তিত। মিছিল আবার একটা সিগারেট ধরালো। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা
বাজল।
(২)
বারো ফুটের একটা ঘর। চারিদিকে শুধু ছাই আর সিগারেটের টুকরো। এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছেঁড়া ডায়রির পাতা। আসবাবপত্র বলতে একটা চেয়ার আর ভাঙা টেবিল। ঘরটা পরিষ্কার করলে হয়ত নবদম্পতির জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা হবে। জানলা খুললেই দেখা যায় সাজানো বাগান। সারি সারি গাছ মাথা তুলে রয়েছে হয়ত তোমার জন্য। ছাদের অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে এই ঘরটা, তাই একটা দরজা খুললেই ছাদের বাকি অংশটা হঠাৎই হাতছানি দেয় আনমনে। বিকেল হলে এই ছাদে দাঁড়িয়ে ফিরে যাওয়া যায় ছোটবেলায়। ঐ দূরে দেখা যায় কদম গাছটা, যেখানে রাত হলেই ভিড় করে জোনাকির দল। চারিপাশে আরও বাড়ি রয়েছে, তবে এই বাড়িটার তুলনায় সবাই ছোট। এ দিকে ত্রিফলার দাপট নেই। যানবাহনও কম চলে।
সন্ধ্যে
হলেই এখানে ঘনিয়ে আসে বিশ্রী অমাবস্যার ছায়া। তবে এই নির্জনতা আমার ভাল লাগে।
এই ঘরটাকে চিলেকোঠার ঘর বললেও ভুল বলা হবে না। তবে এই ঘরটা আমার বড্ড প্রিয়। টাকা থাকলে এই ঘরটা ভাড়া নিয়ে
সারাদিন বসে কবিতা লিখতাম। কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। যেদিন বড়ো লেখক হয়ে যাব,
সেদিন হয়ত এই বাড়িটায় কিনে নেব। কৌশিকের এই ঘরে বসেই এক সময় কত গান গেয়েছি। কত সুর
ভুলিয়েছে আমাদের ভাঙা প্রেমের গন্ধ। কত নেশা আমাদের আরও মাতাল করে দিয়েছে কে জানে।
কৌশিক
তামাক বানাতে বানাতে বলল, ‘’ ভাই, ভাবছি নেশা করা ছেড়ে দেব।’’ আমি একটু অবাক হয়ে
অথচ ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললাম, ‘’ কেন? বউ পরামর্শ দিয়েছে?’’ কৌশিক একটু রেগেই বলল,
‘’ আরে সব ব্যাপারে বউকে টানিস কেন বল তো? এটাই বাঙালীর সবচেয়ে বড়
দুর্বলতা! কিছু হলেই সব বউয়ের ঘাড়ে চাপাবে।‘’ একটু থেমে আবার বলল, ‘’ আরে নিজেই
ভাবছিলাম, এসব ছাই-পাশ খেয়ে কী হবে? তাই বললাম।
‘’ একটু ধমক দিয়ে বললাম, ‘’ বানা
বানা, জলদি বানা!’’ কৌশিক আবার একমনে তামাক বানাতে লাগত আর গুন গুন করে গাইতে
থাকল, ‘’ চলে এসো আজ এ রাতে, চলে এসো আমার সাথে, প্রিয়তমা...’’ এখনও গায়ক হওয়ার
ইচ্ছেটা ওর যায়নি। সেই ছোট থেকে দেখছি তো। বেচারা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাপে একেবারে
পরোটা হয়ে গেছে। তবে অফিস থেকে ফিরেই ওর সেই গায়ক সত্ত্বাটা জেগে ওঠে। সময় পেলে
একটা-দুটো গান ফোনেই রেকর্ড করে ফেলে।
একটা সময় আমরা একসঙ্গে গান লিখতাম।
সুরও দিতাম, তবে এখন সেসব উধাও হয়ে গেছে। স্কুলে পড়াকালীন আমরা অনেকটা সময় একসঙ্গে
কাটতাম শুধু তাই নয় টিউশানও একসঙ্গে নিতাম। স্কুল জীবনের একবারে শেষের দিকে প্রথম
টিউশানের টাকা দিয়ে মদও খেয়েছি। দিনের পর দিন টিউশানে না গিয়ে গঙ্গার ঘাটে বসে গান
নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের একটা ব্যান্ড ছিল, নাম ছিল ওয়েসিস। ইচ্ছে ছিল বাংলা
ব্যান্ডের সংজ্ঞা বদলে দেব। ইচ্ছে ছিল, আমাদের গান সেরার শিরোপা পাবে। কিন্তু
পরবর্তী কালে সেই ব্যান্ডটাই ব্যান্ড হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ কৌশিক বলল, ‘’ এই নে তুই ধরা!’’
তামাক ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘’ তোর
সোহাগের কথা মনে পড়ে?’’
‘’ হ্যাঁ! মানে ঐ ফেসবুকে আপডেট দেখলে
তখন মনে পড়ে। ‘’
‘’ কেমন আছে রে ?’’
‘’ জানি না। এই তো কিছুদিন আগে বিয়ে
হল।‘’
‘’ তাই নাকি! পাত্র কী করে ?’’
‘’ শুনেছি তো উকিল।‘’
‘’ আর আমাদের পাগল প্রেমিক জানে যে
তার প্রেমিকা এখন বিবাহিতা ?’’
একটা লম্বা টান দিয়ে কৌশিক বলল, ‘’ কে
জানে ভাই! আমি আর ওর খবর রাখি না।‘’
‘’ ভালই করেছিস। একদিন ওদের প্রেমের
জন্য আমরা মার খেতে খেতে বেঁচেছিলাম।‘’
‘’ হ্যাঁ ভাই। সেদিন গলি দিয়ে দিব্যি
সোহাগের হাত ধরে কেটে পড়েছিল, আর আমারা ফেঁসে গেছিলাম।‘’
‘’ প্রেমের জন্য লোকে কত কাছের
বন্ধুদের যে ভুলে যায়, এটাই তার আদর্শ উদাহরণ।
‘’ তুই হঠাৎ সোহাগের কথা বললি, কী
ব্যাপার ?’’ কৌশিক একটু মিচকি হেসে বলল।
‘’ আরে এমনি। এই ঘরটাই
এলেই কেমন নসটালজিক হয়ে যায়।‘’
‘’এসব ছাড়, একটা গান শোন!’’ এই বলে
কৌশিক গিটারটা তুলে নিয়ে গাইতে থাকল, ‘’ তুই আমায় পাগল করলি রে...’’
আমি হঠাৎ বললাম , ‘’ তোর কুসুমের কথা
খেয়াল আছে?’’
কৌশিক গানটা থামিয়ে দিল। আর একটা
তামাক ধরিয়ে বলল, ‘’ ভাটপাড়া জায়গাটা আমার জীবনের স্মৃতির চৌহদ্দি!’’
‘’ কেমন আছে ও ?’’
‘’দেখ কোনও বেশ্যাখানায় পরে আছে হয়ত’’
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘’ কেন
? কী হয়েছে ?’’
কৌশিক ধীরে ধীরে বলল, ‘’ ওটা করেই তো ও বেঁচে আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন