অবশেষে- আদিত্য
(১)
“ তোমার
জন্য দিনে দিনে আরও ক্ষয়ে যাচ্ছি!’’
‘’ আবার
একটা নেগেটিভ গল্প লিখতে বসেছিস। কেউ পড়বে না।‘’
‘’ তুমি
তো পড়বে।‘’
‘’ হয়ত!
সময় পেলে ভেবে দেখব।‘’
‘’ সময়
এখন তোমাকে খুঁজছে, আর আমি খুঁজছি আমাদের ফেলে
আসা সময়কে।‘’
‘’ খুঁজিস
না! শুধুই কষ্ট পাবি।‘’
‘’ কী
আর করব? তোমাকে তো পেলাম না।‘’
‘’ কোনওদিনও
পেতিস না।‘’
‘’ হুম,
পেতাম! যদি তোমার সঙ্গে আগে দেখা হত।‘’
‘’ তাও
পেতিস না!’’
‘’কেন?’’
‘’ আমি
তোর চেয়ে দশ বছরের বড়।‘’
‘’ তাতে
কী হয়েছে? সমাজ মেনে নিত না? আমি থোড়াই সমাজকে তোয়ক্কা করতাম।‘’
‘’ তুই
না করলেও তো, আমি করতাম।‘’
‘’ তোমার
জন্য এখনও সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।‘’
‘’থাক!
অত প্রেমিক হতে হবে না। আমি বেশ ভাল আছি, স্বামী, মেয়ে আর আমি। আমাদের ছোট্ট সংসারে
আর কিছুর অভাব নেই।‘’
‘’ আছে!
তুমি জানো না।‘’
‘’কী
শুনি ?’’
‘’ কিছু
কথা গোপন থাক না।‘’
‘’ ছাড়
বলিস না। চল টাটা, পড়তে বসব! ডিসেম্বরে পরীক্ষা।‘’
‘’ অনেক
দেরি আছে!’’
‘’ একদম
নেই । তার মধ্যে ননদের বিয়ে আছে, কিছুদিনের জন্য কলকাতায় যাব। অনেকটা সময় নষ্ট হবে।‘’
‘’ সেই
তোমার কুচুটে ননদ? যে আমাদের প্রেম দূরবীন দিয়ে দেখত ?’’
জয়ী
হাসতে হাসতে বলল, ‘’ হ্যাঁ! সেই মেয়েটার বিয়ে। তাই কলকাতায় যেতে হবে।‘’
‘’ আমার
সঙ্গে দেখা করবে না ?’’
‘’ জানি
না! সময় পেলে নিশ্চয় করব।‘’
‘’ তোমাকে
একবার ছুঁয়ে দেখব জয়ী!’’
‘’ না,
একদম না। তুই জানিস…’’
জয়ীকে
থামিয়ে বললাম, ‘’ সব জানি! কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া ভাল থাকব না।‘’
‘’ ধুর
বাল! তুই যা তো। সেই একই কথা। একই ন্যাকামি। কতবার বলব ওসব ভুলে যা। সেই বাচ্চাদের
মতো নাটক করছিস।‘’ একটু থেমে বললাম, ‘’ নাটক ? ওটা তো তোমার থেকে শিখেছি।‘’ ‘’ বাজে
বলিস না! আমি কোনওদিনও নাটক করেনি।‘’ ‘’ তাহলে একবার বলো ভালবেসেছিলে।‘’ জয়ী বলল, ‘’
চল টাটা! পরে কথা হবে। ‘’
এখন
রাত নামলেই বুকের মধ্যে কতগুলো ব্যথা একসঙ্গে জটলা পাকায়। ঘুমোতে দেয় না। শুধু একটা কথা
বারবার মনে করিয়ে দেয়, ‘ যখন এসেছিলে, তখন কেন এসেছিলে ?’ জানি না কেন এতটা জড়িয়ে গিয়েছি, হয়ত সত্যি
ভালবেসেছিলাম বলে! জয়ী আমাদের ভালবাসাটাকে যেমন নষ্ট করেছে, ঠিক তেমনি আমাদের
সম্পর্কটাকে নষ্ট করছে প্রতিদিন। জয়ী ভুলে গিয়েছে ভালবাসার সম্পর্ক বাদে আমাদের
আরও একটা সম্পর্ক আছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক!
(২)
হলদেটে
পাতাগুলো অবরোধ ডেকেছে চুপিসারে! বসন্ত এসে থমকে আছে কোনও প্রেমহীন নগরীতে। এখন একটা
ঠাণ্ডা হাওয়া জটলা করে রোজ সকালে। এই প্রেমের মরসুমে ঘুম ভাঙে প্রতিবেশীদের খুনসুটিতে।
নোংরা ফেলার গাড়ি বাঁশি বাজায় প্রবল উৎসাহে।
একটা উৎসবের সূচনা কিংবা দশমীর বিষাদ! ঠিক এই ভাবেই এক একটা দিন উবে যায় আমার বয়স থেকে!
একটা
প্রাচীন বাড়ি। প্রাচীন তার রীতি! তুমি এই বনেদিয়ানার ফাঁকে বড্ড আধুনিক এবং আনকোরা।
শব্দহীন নগরীতে যখন নতুন প্রাণ খেলা করে, তখন চারিদিক আলোয় ভরে উঠে। সেজে ওঠে সব বার্ধক্য।
সেরে যায় জটিল রোগ। একটা চিনচিনে আনন্দ বাসা বাঁধে বুক জুড়ে। মনটা কেমন দমকা হাওয়ার
তালে মাদল বাজাতে থাকে, সুরে সুরে কেউ গান বাঁধে আমার দালানে। একটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডার
রাতে, তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকা কোনও পাগল বালক ভুলে যায় সব পিছুটান। অনিমেষ- মাধবীলতার
গল্পের সূচনা কিংবা অমিত-লাবন্যের উপসংহার, হয়ত আমাদেরই অতীত! রবি-রানুর আদরের দাগ আসলে আমাদেরই ভালবাসা। কে জানে, আমারা কী ছিলাম কিংবা কোথায় থাকব ? তবে
যেখানেই থাকব, ভাল থাকব। শুধু থমকে যাবে আমাদের
অবৈধ সময়টা! একটা লোডশেডিং-এর রাতে দমকা হাওয়ার মতো উড়ে আসবে আমাদের সময়টা। ইনজেকশন-এর
মতো সূচ ফুটিয়ে দেবে শিরায়! অবশ করে দেবে আমাদের শরীরকে। আবার ভাবতে বাধ্য করবে,”যদি
আমারা প্রেমিক-প্রেমিকা হতাম, তবে এই উপন্যাসটা হয়ত জন্মাত না! হয়ত কোনও অসুখ এইভাবে
বাসা বাঁধত না চিলেকোঠায়। “
তোমাকে
বৌঠান ডাকার বদলে হয়ত অন্যকিছু বলে সম্বোধন করতাম। হয়ত তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য এতকিছু
পসরা সাজাতে হত না। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য একটা একটা বিকেল আমাকে অপেক্ষায় রেখে যেত
না! কিন্তু হয়ত তোমাকে পায়নি বলেই জয়ীকে এতটা ভালবাসতে পেরেছি। সিটি অফ জয়ের বুকে জয়ী
হয়ে উঠেছি কত সহজেই। বৌঠান, তুমি আর জয়ী আলদা! কিন্তু তুমি আর জয়ী এক! দুজনেই একটা
নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছ। দুজনেই ভালবাসতে
শিখিয়েছ। তোমরা দুজনেই একটা আয়নার এদিক- ওদিক। তোমারা দুজনেই ঝরা বসন্তের রূপকথা।
(৩)
এই বাড়িটার
বয়স প্রায় ১৫০ বছর। চারিদিকেই অনেক ইতিহাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাওয়াটা আরও জোরালো হচ্ছে।
আলোটা আরও জোড়ে দুলছে। আমরাও আরও উসাদী হয়ে যাচ্ছি। আমার বারবার ইচ্ছে করছে জয়ীকে জড়িয়ে
ধরতে। চুমু খেতে ইচ্ছে করছে ওর সিক্ত ঠোঁটে, কিন্তু কী একটা আমাকে আটকে রেখেছে। জয়ী
একটু থেমে উত্তর দিল, ‘’ মেয়ে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যাবে, এবার আমাকে যেতে হবে। আর কিছু
বলার থাকলে বল।‘’ আমি বুঝতে পারলাম জয়ী এইসব কিছু এড়িয়ে যেতে চাইছে। আমি বললাম, ‘’ তুমি যখন এড়িয়েই
যেতে চাইছ, তখন এত রাতে ছাদে এলে কেন ?’’
‘’
তুই বললি তাই এসেছি!’’
‘’
তুমি চাইলে নাও আসতে পারতে। ফোনেই জিজ্ঞাসা করতে পারতে। কিন্তু তুমি এসেছ! জয়ী
একাবার বলো আমায় ভালবাস।‘’
‘’
ওটা বলতে পারব না। ওটা অন্য কারুর জন্য রেখেছি।‘’
‘’
জয়ী, তোমার জন্যই আমি আবার সবকিছু ফিরে পেয়েছি। আমার স্বপ্নের চাকরি, আমার
ভালবাসার বাড়ি, সবই তোমার জন্য।‘’
‘’
এবার একটু নিজেকে ভালবাস!’’
‘’
জয়ী, কেন এই রকম করছ?’’ জয়ী আমার থেকে একহাত দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবার জয়ী আমার
হাতটা ধরে বলল, ‘’ আমি চাই তুই ভাল থাক, তাই এইরকম করছি।‘’
‘’
তুমি ছাড়া আমি শূন্য! আমি ফ্যাকাসে।‘’
‘’
পাগল! এইসব কাব্য ছাড়। একটু পজিটিভ থাক। তুই জানিস আমাদের সম্পর্কটা সম্ভব নয়, তাই
এটা নিয়ে কষ্ট পাস না। আমি যেখানেই থাকি, তোর ভালই চাইব।‘’ আমি তখন ভেতরে ভেতরে
অনেকটাই ভেঙে পড়েছি। বললাম জয়ী শেষ একটা কথা বলব? জয়ী বলল, ‘’ কী ?’’ আমি জয়ীকে এক
ঝটকায় জড়িয়ে ধরলাম। ততক্ষণে ঝড়টা তীব্র হয়েছে। আলোটা আরও জোড়ে দুলছে। চারিদিকে তখন
একটা নিদারুন বিষণ্ণতা। হয়ত বাকি কথাগুলো ওভাবেই বলে ফেললাম। রাত হয়েছে, হাওয়া আরও
তীব্র হয়েছে। যাওয়ার আগে জয়ী বলল, ‘’ এবার আসি। দুঃখ পাস না। সারাজীবন আমি তোর
ভালই চাইব।‘’ জয়ীর চোখ তখন ছলছল করছে। অল্প আলোতেও জয়ী হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
জয়ী চলে গেলে। তারপর চারিদিক অন্ধকার। আমি জানি আমার আর জয়ীর ঠিকানাটা চিরকালই এক
থাকবে, তবুও জয়ী আমার নয়। চারিদিক বড্ড অন্ধকার হয়ে এলো। জয়ী হারিয়ে গেল। আমাদের
প্রেমটাও কোথায় উবে গেল।
(8)
জয়ী তুমি কী চাও আমি জানি না!তবে এইটুকুই
জানি তোমার জন্য আমি আরও ক্ষয়ে যাচ্ছি। তোমার কাছে কতগুলো আবদার আছে। প্লিস সম্পর্কটা
শেষ করে দিও না। আমাদের সারাজীবন এটা নিয়েই মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকবে সেটা আমি চাই না।
আমি চাই তুমি বড্ড ভাল থাক। তবে বারবার কাছে এসেও কেন দূরে চলে যাও ? কীসের ভয় ? আমি
জানি আমরা কোনওদিনও এক হতে পারব না, কিন্তু কাছাকাছি তো থাকতে পারি ? কাল জয়ী ফোন করেছিল। জিজ্ঞাসা
করলাম ‘’কবে আসছ ?’’ জয়ী বলল, ‘’ দেখি, ঠিক জানি না!’’ বুজলাম কাছের মানুষ যত পর
হয়ে যায়, ততই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। একসময়ই বিকেলে আমরা একে অন্যের অপেক্ষায় থাকতাম,
আর এখন বিকেলগুলো আমাদের অপেক্ষায় থাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন