খাই খাই বাঙালির বুকে ব্যথা হবে না, এও কি সম্ভব? যুগে যুগে বাঙালি জাতি নিজেরাই ডাক্তারি করে মোটামুটি বুঝে নিয়েছে বুকে একটু-আধটু ব্যথা মানেই ওটা গ্যাসের সমস্যা। আসলে বাঙালি জাতি এটা মানতেই অস্বীকার করে যে বুকে ব্যথা হৃদয় ঘটিত বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সেটা অনেক সময় হার্ট এট্যাক এর লক্ষণও হতে পারে। উঁহু, অযথা ভয় পাওয়ার জন্য নয় এই লেখা নয়। উপরন্তু এই লেখা শুধুমাত্র একটা প্রাণ বাঁচানোর জন্য। তবে ডাক্তার বাবু বিশ্বাস মহাশয় কফি খেতে খেতে কহিলেন, " আধুনিক জীবনে আমি একটা স্মার্ট ওয়াচ ব্যবহার করতে পারলে, বুকে হঠাৎ ব্যথা হলে একটা ইসিজি করিয়েও দেখতে পারি। আমরা যদি বুকে ব্যথা ব্যাপারটা চেপে যায় তাহলে আর কি আধুনিক হলাম, তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়ে লাভ কোথায়?"
কফির কাপে চুমুক দিয়ে ডাক্তার বিশ্বাস আরও জানালেন যে, " আমাদের বুঝতে হবে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকটা এগিয়েছে, তার সঙ্গে আমাদেরও এগোতে হবে। বুকে ব্যথা মানেই গ্যাস এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা গ্যাসের ওষুধ খাওয়া মানেই সমস্যার শেষ এটা ভাবা একদমই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।"
একটু থামলেন।তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলেন, " আধুনিক জীবন খুব দ্রুত গতির, সেই সঙ্গে সবার জীবনেই অনেক রকমের পারিপার্শ্বিক চাপ, স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন রয়েছে যা হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, হার্ট এট্যাকের মতো লাইফ স্টাইল ডিজিসগুলোকে বাড়িয়ে তুলেছে। তাই আমাদের কোনও ব্যথাকেই ছোট ভেবে ভুল করা উচিত নয়।"
একটু থেমে তিনি আরও বললেন, "অনেক সময় আমরা ডাক্তারা ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি শুনে রোগীর ব্যথার ধরন আন্দাজ করতে পারি। যেমন দপদপ করে ব্যথা( থ্রবিং পেন), ভোঁতা বা ছড়ানো ব্যথা( ডিফিউস ব্ল্যান্ট পেন বা গ্যাস হওয়ার দম বন্ধ ব্যথা এবং সঙ্গে বুকে অস্বস্তি), কখনও তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা( শার্প শুটিং পেন বা প্লুরেসির ব্যথা) আবার অনেক সময় বুক চিনচিন করা মারাত্মক ব্যথা ও ঘাম(এনজিনা পেকটরিস বা হার্ট এট্যাকের ব্যথা)। এছাড়াও আমরা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে ব্যথার কারণ এবং মূল রোগটির দিকে পৌঁছাতে পারি।"
ডাক্তার সোমনাথ বিশ্বাস বেশ কতগুলো রোগ এবং তার লক্ষণগুলোর উপর আলোকপাত করলেন-
১) বয়স বাড়লেই সতর্ক থাকুন। বিশেষত এখন চল্লিশ বছর বয়স হলেই নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকুন, এখন চল্লিশ বছর বয়স কিংবা তার অনেক কম বয়সেও অনেকেরই মধ্যে হার্ট এট্যাক বা করোনারি আর্টারি ডিজিস ভেবে ভুল করবেন না। তাই কোনও বুকের ব্যথাকেই গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করবেন না।
২) হার্ট এট্যাকের মূলত বুকে ব্যথার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, বাঁ-দিকে হাতে ব্যথা, বাঁ-চোয়ালে ব্যথা এগুলো হতে পারে। অনেক সময় পিঠের মধ্যিখানে ব্যথাও হার্ট এট্যাকের কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে।সঙ্গে প্রচন্ড ঘাম হওয়াও হার্টের অসুখের লক্ষণ হতে পারে।
৩) যাদের হাইপারটেনশনের(উচ্চরক্ত চাপ) ইতিহাস আছে তারা নিয়ম করে ওষুধ খান অথবা প্রতিনিয়ত চেকআপে থাকুন।লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করুন। ক্যারোটিড আর্টারির ড্রপলার পরীক্ষা, সিটি আনজিওগ্রাম, ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের কোনও অসুখের পূবাভাস আছে কিনা সহজেই জানা যায়।
৪) অনেকসময় শরীরে জানান দেয় না যে হার্ট এট্যাক হবে বা কিছু। তাই সময় মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। ডাক্তারি পরিভাষায় একটা কথা আছে, 'ডোর টু বেলুন টাইম' অর্থাৎ যেটাকে সহজে অনেকেই গোল্ডেন টাইম বলে থাকেন। আসল ব্যাপারতা হলো হার্ট এট্যাক হওয়ার পরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা। এই সময়ে আমরা চিকিৎসা শুরু করলে অনেক রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব।
৫) বুকে ব্যথার কারণ অনেক সময় কস্টোকনড্রাইটিস হতে পারে। অর্থাৎ পাঁজরে ব্যথার ডাক্তারি নাম কস্টোকনড্রাইটিস। অনেক কারণেই জন্যই এই ব্যথা হতে পারে। যেমন আঘাত লাগলে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাশিতে ভুগলে, মাত্রারিক্ত ব্যায়াম করলে এই রোগ হতে পারে।
৬) যারা দীর্ঘদিন ধূমপান করে আসছেন তাদের ক্ষেত্রে বয়সকালে বুকে টিউমার(ম্যালিগন্যান্ট)হতে পারে। সেই টিউমারের লক্ষণস্বরূপ বুকে ব্যথা বা যন্ত্রনা হতে পারে। বুকের এক্সরে, কন্ট্রাস সিটি স্ক্যান এইসব পরীক্ষার মাধ্যমে টিউমার নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে যে ব্যথা হয় তা সাধারণ ব্যথা কমানোর ওষুধে কমে না।
৭) ফুসফুস বা ল্যাংস বাইরের আবরণকে ডাক্তারি পরিভাষায় প্লুরা বলা হয়। এই প্লুরার রোগ বা প্লুরেসিও বুকে ব্যথার কারণ হিসেনে গণ্য হতে পারে।এই ব্যথা খুব তীক্ষ্ণ হয়। শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যথা জোরালো হয়। প্লুরেসি ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাল জনিত কারণে হতে পারে। ফুসফুসে জল জমা বা প্লুরাল ইফুউশনের ক্ষেত্রেও বুকের ওই নির্দিষ্ট অংশে ভারী ভাব বা চাপ বা ব্যথা হতে পারে।
৮) টিউবারকিউলোসিস (টিবি)থাকলেন কাশি বা কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠা ছাড়াও বুকে ব্যথা হতে পারে।পোস্ট টিবি-এর ফ্রাইবোসিস-এর ক্ষেত্রে বুকে খিঁচ ধরা ব্যথা হতে পারে।
৯)ইরোসিভ গ্যাসট্রিটাইসিস, জি ই আর ডি (গ্যাসট্রোইসোফগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ) হলে বুকে ব্যথা, বুক জ্বালা, মুখ তেতো, চোয়া ঢেঁকুর ওঠা ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে হাইপার অ্যাসিডিটি ,গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা জটিল হয়ে পাকস্থলীর দেওয়াল ফুটো করে দেয়(গ্যাসট্রিক পারফোরেশন)।সেক্ষেত্রে বুকে ব্যথা, বমি, বুক-পেশি কার্ডবোর্ডের মত শক্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন তৎক্ষণাৎ জীবনদায়ী অপারেশন(ল্যাপারোটমি) করার প্রয়োজন পড়ে।অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস কিংবা মুঠো মুঠো গ্যাসের ওষুধ খাওয়া ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যাকে 'সাধারন গ্যাসের ব্যথা' হিসেবে অবহেলা করার ফলে এই পরিণতি হতে পারে।
১০)গলব্লাডার স্টোনেও অনেক সময় বুকে ব্যথা হতে পারে। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পেট থেকে ব্যথা বুকে কিংবা কাঁধের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১১) প্যানক্রিয়াটাইসিস এর ক্ষেত্রে ব্যথা শুধু পেটের উপরি ভাগে নয় বুকেও ছড়াতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপান এই রোগের জন্য দায়ী।
১২)মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তনে টিউমারও বুকে ব্যথার কারণ হতে পারে। তাই স্তন বৃন্তের পরিবর্তন কিংবা স্তনের আশেপাশে মাংস পিণ্ড কিন্তু টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। তাই বেগতিক বুঝলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং মেনোপোস পেরোলেই নিজের স্তন নিজের পরীক্ষা করুন( সেল্ফ ব্রেটস এক্সাম)।
(বি.দ্র- এই প্রতিবেদনটি কয়েকটি মাত্র তাৎক্ষণিক লক্ষণের ওপর ভিত্তি করার লেখা। তাই কোনও সিন্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারি পরামর্শ নিন। অযথা চিন্তিত হবেন না।)
(ডা. সোমনাথ বিশ্বাস
এম.বি.বি.এস(ডাবলু.বি.ইউ.এইচ. এস)
স্পেশাল ইন্টারেস্ট ইন চেষ্ট মেডিসিন , ক্রিটিক্যাল কেয়ার।
সাক্ষাৎকার- আদিত্য ঘোষ)
খুবই প্রয়োজনীয় তথ্য।তাইশেয়ার করতে চাই।
উত্তরমুছুন