আদিত্য ঘোষ, নৈহাটি:
অনেকদিন বাদে পূজারা একটু মেরে খেলল। একদম ঝকঝকে ইনিংস। চেনা ছন্দের বাইরে খেললে পুরোনো খেলোয়াড়কেও নতুন মনে হয়। মনে হয় বুড়ো হাতের ভেলকি দেখাচ্ছে। সেই খেলা দেখতে বেশ লাগে। মনে হয় আরও অনেক্ষণ এই খেলা চলুক। ঠিক যেমন এই আমি নেই আমি দেখতে দেখতে মনে হলো সর্বজিৎ সরকারকে আরও একটুখানি দেখি। আরও বুড়ো হাতের ভেলকি দেখি। বুড়োটা কিন্তু থিয়েটারের সিনিয়রের অর্থে ব্যবহার করলাম। বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড় হলেও সবর্জিৎ কিন্তু থিয়েটারের মঞ্চে প্রবীণ। নৈহাটি এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সামান্য নামডাক আছে বৈকি তবে গল্পের সঙ্গে সর্বজিৎ-এর কিছু মিল আছে। এ যেন সর্বজিৎ-এর নিজের গল্প। নিজের রোজনামচা মঞ্চে আলোর ঘেরাটোপে, নিজের ছায়ার গল্প। নিজের সঙ্গে নিজে আরও কিছুক্ষণ।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ন'টা সাত। নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে সবে শুরু হলো নারায়ণ স্যানালের লেখা নাটক এই আমি নেই আমি। মূল চরিত্রে সর্বজিৎ সরকার। বিগত কয়েক বছরে সর্বজিৎ সরকারে অভিনয় বড্ড একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল সর্বজিৎ একটা সাজানো বৃত্তে হারিয়ে যাচ্ছে। বড্ড মেলোড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে। নৈহাটি আরশি প্রযোজিত নাটক এই আমি নেই আমি দেখার পর এই কথাটা আর খাটে না। সর্বজিৎ সরকার নিজেকে ভেঙেছে। পরিণত হয়েছে অনেক। নৈহাটি আরশিও ভাল কাজের দলে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। নাম লিখিয়েছে সুস্থ সংস্কৃতির পক্ষে।
এই নাটকের মূল চরিত্র সর্বজিৎ ওরফে অনিরুদ্ধ নাটক পাগল। নাটকের প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখছি এক পিতা তার নাটক পাগল ছেলেকে বলছেন, ডাক্তারের কথা মতো চলতে। সময় মতো ওষুধ খেতে। খুব ছিমছাম মঞ্চসজ্জা। তবে এই সাদামাটার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আসল রসদ। সর্বজিৎ-এর অভিনয় সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ছাপিয়ে গিয়েছে জয়সিংহ, অপর্ণাকেও।
কচি কলাপাতার রঙের পাঞ্জাবি পরে অনিরুদ্ধ চলল রিহার্সালে। নাটকই তাঁর জীবন। এই বলে বাড়ি থেকে বেরোল সে, আর বলল আজ অনন্যা আসবে। কে অনন্যা? অনন্যা ছাড়া অনিরুদ্ধ অপরিপূর্ণ। বাসস্ট্যান্ডে অনিরুদ্ধ আর অনন্যার কথোপকথন মনে করিয়ে দিল পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথনকে। একটা ছিমছাম প্রেমের গল্প। এক নাটক পাগল ছেলের গল্প। মঞ্চই যার জীবন। মঞ্চই যার শেষ ভালবাসা। শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য যে সবকিছুকে তুচ্ছ করতে পারে। বারেবারে বিভিন্ন টুকরো চরিত্র দিয়ে এই নাটকের কত কত দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সার্থক পরিচালনা, সার্থক পরিচালক কৌশিক গোস্বামী। এইসবের উর্দ্ধে একজনের প্রশংসা না করলে বড্ড অন্যায় হবে, আলোকশিল্পী আকাশ মুখোপাধ্যায়ের। দুর্দান্ত আলোক ভাবনা এবং প্রক্ষেপণ। নতুন আলোর সন্ধানে আকাশ মফঃস্বলের প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙেছে। নতুন আলোকে সাজিয়ে দিয়েছে এই আমি নেই আমিকে।
অনিরুদ্ধের গলার মাঝেমধ্যেই ফুটে উঠেছে জীবনের না গল্প। ফুটে উঠেছে তার চারিপাশের মানুষজনের কথা যারা থিয়েটারকে পাশে রেখে সরে গিয়েছে অন্য পেশায়। কিন্তু অনিরুদ্ধ শুধুমাত্র থিয়েটারের জন্য থিয়েটারে মন দিয়েছে।
এই নাটকে অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করেছে মৌমিতা। যদিও সর্বজিৎ-এর সঙ্গে সেভাবে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি। তবে এই নাটকের সার্থকতার পিছনে তার অবদানও অপরিসীম। রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রীকে সেদিন অনিরুদ্ধ রাস্তায় দেখে যেভাবে তার চোখের সঙ্গে অপর্ণার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাকে মনে গেঁথে ফেলেছিল, আর এই পাগলপারা মানুষটিকে অনন্যার ভাল লেগে গিয়েছিল। তারপর গল্প এগোয় ধীরে ধীরে। কয়েকটি নাটকের টুকরো চরিত্র বারেবারে সর্বজিৎকে জাগিয়ে তোলে। বিসর্জনে আরও আলোকিত হয়ে ওঠে মঞ্চ। আলোকিত হয়ে ওঠে জয়সিংহ এবং অপর্ণা।
তবে গল্পের মোড় পাল্টায় একটা এবড়ো-খেবড়ো ক্লাইম্যাক্সে। নাট্যকার নারায়ণ বাবুকে প্রশ্ন, এই আদ্যিকালের ক্লাইম্যাক্সের দরকার ছিল কি? এই ক্লাইম্যাক্সটা কী সেটা দেখার জন্য অন্তত প্রেক্ষাগৃহে আসুন। নাটক দেখুন। থিয়েটারের পাশে থাকুন।
তবে ব্যক্তিগত স্তরে একটা কথা না বললেই নয়। সময়টা তখন ডিসেম্বর। তীব্র ঠান্ডার মধ্যে ঠিক এইরকম মধ্যরাতে আমি এবং সর্বজিৎ সরকার সিগারেট হাতে ঠান্ডায় কাঁপছি। আমাদের সামনে একটা সাজানো বাগান। সর্বজিৎ সরকার বলে উঠল,'' একদিন একটা উপন্যাস লিখব।" জিজ্ঞাসা করেছিলাম," কী লিখবে?" সর্বজিৎ বলেছিল," নিজের জীবনের গল্প।"
কাল সকালে তো আবার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবে সর্বজিৎ, মধ্যবিত্ত ঘরে রুটিরুজির জোগান তোমাকে আবার থিয়েটার থেকে দূরে রাখবে এক সপ্তাহ। তোমার উইকএন্ডই তোমার আসল বাঁচার রসদ। যেখানে তুমি বেঁচে থাকাকেই 'দুর্ঘটনা' বলো। কী সর্বজিৎ, মঞ্চ না জীবন নাকি জীবনটাই মঞ্চ? আজ রাতে অজস্র হাত তালির আওয়াজ তোমাকে কি ঘুমাতে দেবে নাকি আরও আরও হাততালির আকাঙ্খা তোমাকে জাগিয়ে রাখবে আরও অনেক রাত?
তিথি নক্ষত্রের মাঝে এইভাবে বেঁচে থাকুক অনন্যা, অপর্ণারা। সফল হোক বিসর্জন। সফল হোক ভালবাসা।ঘড়ির কাঁটায় তখন দশটা বাজতে পাঁচ। প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি দর্শকের হাততালিতে তখন সবটা আলোকিত। এখানেই তো এই আমি নেই আমির সার্থকতা। (ছবি-সৌভিক মন্ডল)
dhonnobad,Aditya...ei vabe ekjon darsok er kotha guchie lekhar jonno
উত্তরমুছুন