পার্থ ঘোষ
সরযূবালার ঘোলাটে চোখের
ঝাপসা দৃষ্টি স্বামী হৃদয়নাথের আবছা ছবিটার ওপর আটকে রয়েছে অনেকক্ষণ ধরে। ছবিটা তাঁর কোলের ওপর দুই শীর্ণ হাতের
বন্ধনে আবদ্ধ। স্যাঁতস্যেঁতে প্রায়ান্ধকার
ঘরের আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলার মধ্যে ইঁদুর, আরশোলা এবং টিকটিকির
স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র। দেয়ালের খসে পড়া
চুনকাম ও গর্ত হয়ে যাওয়া রং-চটা মেঝের
অপরিসর ঘরটাই এখন তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল।
জামাইয়ের করুণার দান।
জীবনের সত্তরটি বছর
কাটিয়ে ইঞ্জিনীয়ার ছেলে রুদ্রাক্ষর সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে শেষ
আশ্রয়স্থল হিসাবে একমাত্র জামাই – সরকারী অফিসের কেরানী অজিতাভ রায়ের গলগ্রহ হয়ে
এই মাথা গোঁজার জায়াগাটা পেয়েছেন সরযূবালা। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর চাপা ক্রোধের
সূচালো তীরের আঘাতে জর্জরিত মন যখন ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে, তখনই স্বামীর ছবিটা
দু’হাতে ধরে নিভৃতে বসে হারিয়ে যান অতীতের দিনগুলোয়।
ছানি পড়া দু’চোখ থেকে
কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে ছবির কাঁচে। ইঞ্চি-পাড় শাড়ীর আঁচল দিয়ে সযত্নে মুছে দেন
কাঁচটা। পুরান ছবিটা একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেন, কিন্তু
দূরত্বটা একই রয়ে যায়; আগের মতই।
সরযূবালার এখন আর বাঁচতে
ইচ্ছে করে না। সকাল সন্ধ্যে ঈশ্বরের কাছে
প্রার্থনা জানান সংসারের মায়াজাল
থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু, তাঁর সেই প্রার্থনা শুনতে পান না ঈশ্বর।
কিংবা শুনতে পেয়েও গুরুত্ব দেন না তাঁর ভগবান। তবুও হাল ছাড়েন না সরযূবালা।
যতদিন হৃদয়নাথ বেঁচে
ছিলেন, ততদিন মৃত্যুর কথা মনে হত না তাঁর।
কখনও ঠাট্টা করে বলে ফেললেও স্বামীর প্রেমময় তিরষ্কার সহ্য করতে হত
তাঁকে। হৃদয়নাথ বলতেন – ‘আমি বেঁচে থাকতে
মরা-র কথা মুখে আনবে না।’
তিনি চলে গেছেন পনের বছর
হয়ে গেল। তারপর থেকে দুঃখের দিনগুলো একে একে আসতে শুরু করেছে সরযূবালার জীবনে।
স্বামীর মৃত্যুর পর
পুত্রের সঙ্গে দিনগুলো ভালোই কাটছিল; কিন্তু, অর্পিতার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে
ক্রমশঃ ছেলে পাল্টে যেতে লাগল। আধুনিক
পুত্রবধূর জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে ঠিকমতো মেলাতে পারছিলেন না সরযূবালা। স্বভাবতই সাংসারিক অশান্তির সুত্রপাত হয়েছিল।
প্রথম দিকে শাশুড়ী বৌ-এর
মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছিল মেয়েলী ঝঞ্ঝাটগুলো। কিন্তু একদিন সীমানা টপকে এসে পড়ল রুদ্রাক্ষর
সামনে। ফলে, সাধারণ ভাবেই ঘটনাও সেদিকে অগ্রসর হল। যুবতী স্ত্রীর প্রতাপের কাছে
হার মানতে হল স্বামীকে। বিধবা বৃদ্ধা মা-র
প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল ছেলের কাছে। অতীত
বিস্মৃত হল রুদ্রাক্ষর অন্তর থেকে।
ঠিকানা পরিবর্তিত হল
সরযূবালার। মায়ের মনের কষ্ট মেয়ের মনে
ক্ষত স্থানের সৃষ্টি করল। মেয়ের হাত ধরে
জামাইবাড়ী এসে উঠলেন তিনি, কুণ্ঠিত মনে, লজ্জা জড়ান শিথিল পদক্ষেপে।
মেয়ের সংসারে এসে
সরযূবালা বুঝতে পারলেন কোথায় একটা ছন্দপতন ঘটেছে। জামাই অজিতাভর চোখের কোণের বিরক্তির
কালো ছায়া তাঁর ছানি পড়া ঘোলাটে কণীনিকায় ঝিলিক দিয়ে গেল। বুঝলেন জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টা পরমুখাপেক্ষী
এবং দয়াপরিগ্রহ হয়েই কাটাতে হবে।
ক্রমশঃ তাঁর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল, পুত্রবধূর মত স্বামীকে
বশ করার মন্ত্র আয়ত্ত করার শিক্ষায় শিক্ষিতা হতে পারেনি তাঁর একমাত্র আত্মজা; ফলে, সরযূবালাকে
রঙ-চটা টিনের বাক্সটাকে সঙ্গী করে আশ্রয়
নিতে হল সিঁড়ীর তলার এই অস্বাস্থ্যকর, অপরিসর ঘরটায়।
সৌজন্যমূলক স্বাক্ষাৎ আর
সামান্য কথাবার্তা জামাইয়ের সঙ্গে হয় না যে তা নয়, তবে কালে-ভদ্রে। মেয়ের সঙ্গে
দেখা হয় জামাইয়ের অবর্তমানে । সরযূবালা
বুঝতে পারেন মেয়ের অসহায়তা। দোষারোপ করেন
ভাগ্যকে । ভগবানকে ডাকেন মুক্তি পাবার
জন্য।
এভাবেই দিন কাটছে
সরযূবালার। একাকী সময় কাটাতে চায় না
সারাদিন। আগে নাতনী মুন্নী এসে বসে থাকত।
দুষ্টুমী করত সারাক্ষণ, হরেকরকম প্রশ্নে অতিষ্ট করে তুলত। আজকাল খুব কমই আসে। সময় পায় না পড়াশুনার চাপে। বর্তমানের গতিময় জীবনযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিতে
গিয়ে নষ্ট করার মত সময় আর হাতে থাকে না তার।
গতিশীল সংসারের সঙ্গে দৌড়তে না পারায় পিছিয়ে পড়ছেন সরযূবালা। সবাই তাঁকে
পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। একা একা ঘর আগলে বসে দিন গুনছেন আর আঁকড়ে ধরছেন
স্বামীর সাদা-কালো ছবিটাকে।
মাঝে মাঝে নিজেকে
অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তখন এক ধরণের অবসাদের জন্ম হয় মনের মধ্যে। বিনিদ্র রজনী কেটে
যায় প্রহর গুণে। মনে পড়ে স্বামীর কথা,
যৌবনের দিনগুলোর কথা। স্মৃতির পটে ভেসে
ওঠে দুই ছেলে-মেয়েকে বড় করে তোলার, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার কর্মময় দিনগুলোর কথা; আজ
সেসব শুধুই স্মৃতি। কালের গতিতে, সমাজ ব্যবস্থার চাপে আর জীবনের গোলক ধাঁধায় সব
কিছু আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান।
নিথর, নিশ্চল, স্থবির
শুধু সরযূবালার জীবন, হৃদয়নাথের বাঁধান ছবিটার মত। সেজন্যই তিনি একভাবে তাকিয়ে
থাকেন ছবিটার দিকে ঝাপসা চোখে; আর ভাবেন, কতদিনে তাঁর ছবিটাও এভাবে বন্দী হবে
কাঁচের আড়ালে। পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকার নিষ্পত্তি হবে সেদিন।
----()------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন