স্বপ্নে নয় বাস্তবে
পার্থ ঘোষ
কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আসলে মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছা। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত কোন ইচ্ছা ঘুমের মাঝে মাথার ভেতরে আন্দোলিত হতে থাকে আর তখনই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসে আমরা যেভাবে সিনেমা দেখি ঠিক সেভাবে স্বপ্নকে দেখতে থাকি।
স্বপ্ন অনেক রকম হয়, আনন্দের দুঃখের, ভয়ের এমনকি দোষের। যদিও দোষ বলার কারণ চিন্তা করতে গেলে একটু গভীরে ঢুকতে হবেই। হাটে বাজারে স্বপ্নের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী অভিনয় অনুশীলন করতে গেলে সেটা অবশ্যই বেআইনি এবং দৃষ্টিকটু বলেই গণ্য হয়। সেই কারণেই মনে হয় স্বপ্নের মধ্যে সেই চিত্রায়ন দর্শন করাটাকেই আমরা স্বপ্নদোষ বলি সাধারণভাবেই। এটাও ঠিক কোনভাবে জেনে বা না জেনে ওইসব শিহরণ জাগান নাট্যরূপকে মনে স্থান দিলেই এই পরিণতি শিকার হতে হয় ঘুমের মধ্যে। এটা অস্বীকার করা খুবই শক্ত দূষিত স্বপ্নের দর্শকদের । এটাই বাস্তব।
যাক যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আজ একটা স্বপ্ন দেখলাম ঘুমের মাঝে। কাল রাতে ঘুমোতে যেতে একটু বেশিই রাত হয়ে গেছিল। রাত করে শুতে যাওয়াটা আমার একটা নেশার মত। রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে একাকী বেশ লাগে। রহস্যময়ী রাত। অনেকটা নারীর মত। পরতে পরতে রহস্য রাতের শরীরে। রাতের এক একটা প্রহর যেন যুবতীর শরীরের এক একটা ভাঁজ। রাতের নিস্তব্ধতা যেন যুবতীর বলা কথার না বলা বাকরুদ্ধতা। রাতচোরা পাখির ডাক যেন যুবতী শরীরের চাহিদার বহিঃপ্রকাশ। রাতের একাকীত্ব যেন যুবতীকে একলা পাওয়ার উপলব্ধি।
কাল শুতে যাওয়ার দেরী হবার কারণ লুডো। অবসর সময় যাপনের এক অসাধারণ খেলা। উত্তেজনা, জয়ের আনন্দ, দৌড়ের গতিময়তা, বুদ্ধির গাছের গোড়ায় সার দিয়ে মস্তিষ্ককে উর্বর করার এক উৎকৃষ্ট খেলা এই লুডো। শত্রুকে তুমি কিভাবে নিকেশ করবে তার প্রাথমিক শিক্ষা এই লুডোর বোর্ড থেকেই জন্ম নেয়।
এছাড়াও এই লুডো কিন্তু অনেকটা সার্কাসের মত। সার্কাস উপভোগ করার বয়স নেই, লুডোরও তাই। সার্কাসে শিশু দেখে জোকারের খেলা, বয়স্ক চোখ দেখে ট্রাপিজের খেলা আর খেলুড়ে নারী। লুডোও তেমনি এক ইউনিভার্সাল গেম।
সেই লুডো খেলতে খেলতে রাত মধ্য। অনলাইন লুডো। একেক জন খেলুড়ে এক এক জায়গায়। কেউ কলকাতায় তো কেউ বর্ধমান, কেউ কৃষ্ণনগর, কেউ আসানসোল, দারুন মজা। এ যেন সারা বাংলা লুডোর লড়াই।
খেলা যত এগোয় উত্তেজনা বাড়ে। যে যার ঘরে বসেই উরু চাপড়ায়, উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে আবার অনায়াসে বলেও ফেলে, ‘দূর শ্লা’! না, এর থেকে অশ্রাব্য কিছু বেরোয় না মুখ থেকে কারন পরিবারের মধ্যে বসে খেলা তাই সেন্সর আবশ্যক।
সেই লুডোর লড়াই শেষ হতে হতে রাত মধ্য হয়ে গেল। নেশা একেই বলে। এভাবেই নেশার ঘোরে আগেকার দিনের জমিদাররা রাত কাটিয়ে দিত বাঈজী বাড়ী মদ আর মেয়েমানুষের সাহচর্যে। এখন সেদিন বিদায় নিয়েছে এখন নাচা, গানা, নিষিদ্ধ দর্শন সবই মুঠোফোনের নাজুক স্পর্শ শরীরের ছয় ইঞ্চি পর্দায়।
সে যাক। লুডো খেলার শেষে বিছানায় ছুঁড়ে দেওয়া শরীর জুড়ে নেমে আসা ক্লান্তি, চোখের পাতায় নেমে আসা ঘুম আর ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে অক্সিজেনের অভাবকে পূরণ করতে একটা লম্বা হাই... তারপর নিঃশব্দ গুড নাইট।
এরপরই শুরু স্বপ্নের খেলা। এই হাই তোলা যেন অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে পরিবেশের পরিচয় পত্র। ঘুমের প্রেক্ষাগৃহে তখন শুরু হয়ে গেছে স্বপ্নের চলচিত্র। কখনো রঙিন, কখনো সাদা কালো। বাস্তবে সব এরকমই, কিন্তু স্বপ্নের ছবিতে কি সেসব রং ফোটে? বুঝতে পারি না। মনেও থাকে না। তবে চরিত্র ও দৃশ্যগুলো বড় চেনা লাগে। আর সেগুলোই যখন বাস্তবে দেখি তখন রঙিন লাগে। সত্যি বেঁচে থাকাটাই অনেক রঙের সমাহার। যদিও বেঁচে থাকাটার কোন স্থায়িত্ব নেই, মৃত্যুই সত্য; বেঁচে থাকাটা একরকম স্বপ্নই।
আমার বন্ধ চোখের সামনের কালো পর্দায় একে একে ফুটে উঠছে সচল ছবি। বাস্তবের প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে দুটো পার্থক্য, প্রথমত, প্রেক্ষাগৃহের পর্দা সাদা আর এখানকার পর্দার রঙ কালো। কালো বলেই সব রং সাদা পর্দায় দেখা ছবির মত স্পষ্ট হয় না। দ্বিতীয়ত বাস্তবের চলচিত্র চোখ খুলে দেখতে হয় আর স্বপ্ন চোখ বন্ধ করে। তাই স্বপ্ন অস্পষ্ট, ঝাপসা।
আমি ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চারপাশে মানুষের ঢল। কেউ হাসছে, কেউ কথা বলছে, কেউ বা ঝগড়া করছে। দূরে গান গাইছে একটা মেয়ে, তার একটু পাশে একজন নাচছে, কোন অনুষ্ঠান চলছে। অগণিত মানুষ হাততালি দিচ্ছে । রাস্তার মোড়ে খাবারের স্টল। তৃপ্তিকর খাদ্য গ্রহণ করতে করতে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত মানুষ। স্বপ্নের মধ্যেও একটা সুখানুভুতি কাজ করছে সুপ্ত মনের গভীর গোপনে।
যান্ত্রিক শব্দ তুলে দৌড়ে গেল একটা বাইক, তার পেছনে একটা টোটো, তার পেছনে একটা অটো টোটোটাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছে। জমজমাট বাজার এলাকা।আমি ঘুরছি, খাচ্ছি- ফুচকা, আলুকাবলি, মুড়ি মশলা। আমার বাহু জড়িয়ে এক সুন্দরী মহিলা। তার গায়ের পারফিউমের গন্ধ মেয়েলি শরীরের গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে এক স্বর্গীয় সুবাসের সৃষ্টি করছে। স্বপ্নের থ্রি ডি, ফাইভ ডি, টেন ডি হয়না তাই গন্ধ নাকে আসে না, অনুভুতিতে ধরা দেয়। নারীর কোমল স্পর্শ সেভাবেই অনুভূত হচ্ছে।
আলোকজ্বল ঝলমলে সন্ধ্যা আজ মধুর। যুবতীর মুখটা ঝাপসা। কে ওই যুবতী? - স্বপ্নপরী! - হবে হয়ত। বোঝা যাচ্ছে না। চেনা যাচ্ছে না ভিড়ে সামিল হওয়া কোন নরনারীর মুখের ছবিও; মুখগুলো কেমন ঝাপসা। তবে কোলাহল, আনন্দ বেশ অনুভূতি সম্পন্ন, স্পষ্ট। যদিও কারো কোন কথাই কানে এসে পৌঁছছে না, তবে তাদের মুখ নড়ছে, দেখতে পাচ্ছি তারা কথা বলছে।
হঠাৎই আমার সঙ্গের যুবতী আমার বাহু ছাড়িয়ে ছিটকে চলে গেল। কাকে ডাকতে ডাকতে সে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি তার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না কিন্তু তার উৎকন্ঠাকে অনুভব করতে পাচ্ছি। আমি দেখছি সে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। আমি তার নাম ধরে ডাকছি, কিন্তু আমার গলার আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আমার কানে কোন শব্দ এসে পৌঁছছে না; এমনকি তাকে কি নামে ডাকছি সেটাও শুনতে পাচ্ছি না।
আমি যুবতীকে ধরতে দৌড়ে যেতে গেলাম আর তখনই হোঁচট খেলাম একটা নরম কিছুতে। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। দেখলাম আমার পায়ের কাছে সারিবদ্ধ মৃতদেহ। শীতল নিষ্প্রাণ শরীরে হোঁচট খেয়ে আমি ছিটকে পড়েছি মৃতদেহের স্তূপে। আমার ভয় করতে লাগল, আমি নিজের শরীরটা তুলতে গিয়ে দেখলাম আমার শরীরে কোন শক্তি নেই। আমি প্রানপনে চিৎকার করতে লাগলাম সাহায্যের জন্য.....
ঘুমটা ভেঙে গেলো। ঘামে ভেজা শরীরটা অবশ হয়ে আছে। একটা ভয়ার্ত, তেঁতো অনুভূতি জড়িয়ে রয়েছে আমার শরীরে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বড় জলতেষ্টা। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নেব সে ক্ষমতাও যেন হারিয়েছি। স্বপ্নটা মনটাকে যেন টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।
একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল। মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগল। স্বপ্ন ও বাস্তবের ফারাকটা স্বচ্ছ হতে লাগল। এবার মনে প্রশ্ন জাগল, কেন এ স্বপ্ন। উত্তর এলো মেঘের চাদর সরিয়ে চাঁদের উঁকি দেওয়ার মত – সারা বিশ্বে মারন করোনা ভাইরাসের প্রকোপের জন্য ঘোষিত ত্রিশদিন গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ সবার। এভাবে থাকতে থাকতে আর খবরের আপডেট দেখতে দেখতে মনটা কাল চাইছিল সেই আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে। সেই করোনা মুক্ত পৃথিবী, যেখানে নেই কোন বাধ্যবাধকতা, যেখানে নেই নিয়মের বেড়াজাল। মানুষের সঙ্গে যথেচ্ছ মেলামেশা, প্রাণ পুরে খাওয়াদাওয়া, আনন্দ, উপার্জন, প্রেম, ভালোবাসা, পরকীয়া, যৌনতার সেই ব্যস্ত পৃথিবী। যেখানে মন ফিরে যেতে চায় বারবার, শরীর ফিরে যেতে চায় বহুবার।সেই দিনের অপেক্ষায় আমি আপনি, আমরা সবাই – একজোট হয়ে একসাথে স্বপ্নে নয় বাস্তবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন