বন্দীদশার ডায়েরী
পার্থ ঘোষ
এক এক করে বেশ কটা দিন কেটে গেল। প্রতিদিনের অভ্যস্ত রুটিন হঠাৎই পাল্টে যাওয়ায় প্রথম প্ৰথম
বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। এখন
সেই অনুভূতিতে ভাঁটা পড়েছে সহজ নিয়মেই। আমরা
অভ্যাসের দাস। একটা অভ্যাস থেকে আর একটা অভ্যাসে পরিবর্তিত হতে সামান্য কিছু সময় অতিবাহিত করলেই যথেষ্ট।
এই ব্যাপারটাও সেরকমই হল। সারাদিনের অখন্ড অবসরে সময় কাটানটাই একটা ব্যাপার। তাক থেকে নামল পুরনো পুজোবার্ষিকী, গল্পের বই, সংকলন, অমনিবাস। বহুদিন পর আবার বইয়ের সঙ্গে সখ্যতা। শুধু বই-ই বা বলি কেন , বই ও বউ দুজনেই এখন হাতের মুঠোয়।
কিছুদিন আগেও যে যার কর্মস্থানে ব্যস্ত হয়ে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি স্বাক্ষাতের সময়টা সকাল আর রাতের ঘেরাটোপে বন্দী হয়েই ছিল। সকালের ব্যস্ততার মধ্যে একে অপরকে “আজ ফিরতে দেরি হতে পারে” বলা কথা আর রাতে পরিশ্রান্ত শরীর দুটো বিছানা নেওয়ার আগে “শুভরাত্রি” বলে ঘুমের কোলে ঢলে পড়া ব্যাপারগুলো কেমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এতদিন পর আবার সেই চলমান জীবনের ঘুরে যাওয়া স্রোতে একে অপরের কাছাকাছি, পাশাপাশি সারাদিন সারারাত। যে জীবনে তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই আছে শুধু অবকাশ।
- “তোমার অনেকগুলো গুলো চুল পেকে গেছে” – “তোমার ভুঁড়িটাও কিন্তু অনেকটাই বেড়ে গেছে” -মাঝে যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে হঠাৎ যেন মনে পড়ে যাচ্ছে।
ঘুমতে যাবার সময়টারও কোন নির্দিষ্ট সময় নেই এখন। ঘুম থেকে ওঠারও নয়। এরই মধ্যে কোনদিন ঘুম আসতেই চায় না রাতে।
নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভগ্ন হয় পথকুকুরদের তারস্বরে চিৎকারে। দূরে কোন গাছে চাঁদের আলোয় বিভ্রান্ত কোকিল সুর তোলে তার গলায়। রাতের মালবাহী ট্রেন যান্ত্রিক শব্দ তুলে এগিয়ে চলে, বুকের ভেতরটা যেন ধকধক করে ওঠে।
নিদ্রাহীন চোখ অন্ধকারে নিদ্রা খোঁজে। অনুসন্ধিৎসু মন বাতাসে দোলা লাগা গাছের পাতার শব্দে মনে করে - নিশ্চয়ই চোর এসেছে ঘরের বাইরে।
কখনো ভোর হতে না হতেই ঘুম ভাঙে। মন চনমনে হয়ে ওঠে বাইরের পৃথিবীকে দর্শন করার আকাঙ্খায়। বিছানার মায়া ছেড়ে উঠে যাই ছাদে। এখন ছাদটাই নিজেকে মেলে দেওয়ার একটা প্লাটফর্ম। বিকেলটা ওখানেই কাটে। সারাদিনের গৃহবন্দীর পর কিছুটা মুক্ত হবার অনুভূতি।
বিশাল আকাশের নিচে দাঁড়ালে নিজেকে বেশ স্বাধীন লাগে, অনেকটাই ক্ষুদ্র লাগে। একাকী ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে মাথাটা যেন কেমন ঘুরে যায়।
বিকেলে ছাদে ছাদে এখন প্রচুর মানুষ; নারী পুরুষ একসাথে। গল্প, কথা, গান, নাচ, মস্করা। এই ভয়াবহতার মাঝেও নিজেকে সামান্য সুস্থ রাখার চেষ্টা।
যদিও এখন বিকেল নয় সকাল। ছাদের ভিড়ে আমি একা। এখন কোন ছাদে মানুষ নেই। কেউ হয়ত ঘুম থেকে ওঠেনি। কিংবা উঠলেও ছাদে ওঠার কথা মনে করেনি। সকালের নরম রোদ, বিশুদ্ধ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যেতেই চনমনে ভাবটা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে। লকডাউনের ফলে সব কিছু বন্ধ থাকায় বাতাসে দূষণের মাত্রা কমেছে অনেকটাই, পরিবেশ বিশারদরা এমনই বলছেন। তাই মাথার ওপর আকাশের গভীর নীল রং আর গাছের শাখায় শাখায় পাখিদের কলকাকলি কেমন যেন বাল্যকালের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কতদিন, কতদিন পর আবার এই আকাশটার নীচে এসে দাঁড়ালাম। কতদিন তোমায় দেখিনি আকাশ। আজ আবার তোমায় দেখছি সেভাবে, যেভাবে ছোটবেলায় ঘুঁড়ি ওড়াতে গিয়ে দেখতাম। আকাশ, আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি, অনেক বুড়োও হয়ে গেছি। তুমি কিন্তু সেই আগের মতোই আছো, নীলাম্বরী, উজ্জ্বল, উল্টো গামলার মত।
জানা অজানা পাখিরা কুজন করছে। এই পাখির ডাক এতদিন হারিয়ে গিয়েছিল কলিং বেলের শব্দে, এই আকাশ হারিয়ে গিয়েছিল শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের কংক্রিটের ছাদের আড়ালে।
সূর্য উঠল। জ্বলন্ত বৃত্ত। অনেকদিন পর দেখলাম। সকালে গ্যাসের বার্নারের আগুনের লেলিহান শিখায় তোমার প্রতিচ্ছবি দেখেছি এতদিন। আজ দেখছি আবার সেই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে, চর্ম চক্ষে।
চারপাশটা খুব নির্মল লাগছে। একটা মোলায়েম নিস্তব্ধতা। পাখির কুজন, দূর থেকে ভেসে আসা বাজার বিক্রেতার হাঁক – বা-জা-র, বা-জা-র..., স্ট্রিট ডগদের কলরব। রাস্তা জনশূন্য হওয়ায় সারাদিন ওদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। আগে ওরা রাত হলেই নিজের হক ছিনিয়ে নেওয়ার দ্বন্দ্বে নামত, এখন সারাদিনই চলছে বেঁচে থাকার লড়াই। ওরাও তো ঠিকমত খাবার পাচ্ছে না। তাই সামান্য খাদ্য নিয়েই চলছে ছিনিয়ে নেবার যুদ্ধ।
সামনে ভয়ংকর দিন। আমাদের খাদ্যের জন্য লড়তে হবে না তো! শরীরে খাদ্যের যোগান থাকলে তবেই লড়াই করা যায়। পরাস্ত করা যায় শত্রুকে। কথাতেই আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়।
মারন ভাইরাসই করোনা, কোভিড-19 নি:শ্বাস ফেলছে ঘাড়ের ওপর। অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই। সায়েন্স ফিকশন।এই সুন্দর পৃথিবী। আমার ল্যাপটপটাও সুন্দর। কিন্তু সেখানেও বাসা বাঁধে ভাইরাস। প্রতিবছর এন্টিভাইরাস কিনতে হয়ে। আমরা এখন জীবনের জন্য এন্টিভাইরাস খুঁজছি। যত তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে ততই মঙ্গল। না হলে আমাদের হার্ডডিস্ক কোরাপ্টেড হয়ে যাবে। তারপর একদিন ল্যাপটপের মত নিশ্চুপ হয়ে যাবে জীবন।
দুপুরে ঘুম আসে না। ঘুম এলে রাতে নিস্তব্ধতা উপভোগ করতে হবে। তাই ঘুমোই না। ঘুমতে ভালোও লাগে না। শরীরের ক্যালোরি খরচা হচ্ছে না। খালি ইনপুট, আউটপুট বলতে শুধুই পটি।বিকেলটা যেন হাতছানি দেয়। বিকেল ঠিক নয়, ছাদ। বিকেল হলেই ছোটবেলায় দৌড় দিতাম মাঠে, একটু বড় হয়ে পাড়ার রকে। তারপর বিকেল হারিয়ে গেছিল অফিস ফেরত ট্রেনের ভীড়ে। এখন আবার গোধূলিবেলার হলুদ আলো মাখি ছাদের ওপর গিয়ে। কনে দেখা আলো।
ছাদে ছাদে অনেক মানুষ। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে। অক্সিজেন নিচ্ছে। কোন ছাদে অষ্টাদশী নাচ করছে মোবাইলে গান চালিয়ে। কেউ বা হেডফোন কানে ব্যস্ত সংগীত শ্রবণে। কারো চলছে শরীর চর্চা - লাফদড়ি, বৈঠক, বুকডন, খালি হাতে ব্যায়াম। প্রেম ও হচ্ছে কোথাও। ওটা শ্মশানেও হয়, হয় মর্গেও। ওর কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই।
ছাদে ছাদে দেখা, ফোনে ফোনে কথা। এখন অবশ্য দেখাও ফোনে হয়ে যায় ভিডিও কলে। কনে দেখা আলোয় কনে খোঁজা। ভাইরাসের বাবার সাধ্য কি তাকে আটকায়।
ছাদ থেকে চোখ রাস্তায়। ওরা যাচ্ছে। ওরা সর্বদাই যায়। কোন নিয়ম মানে না। ভাবটা এমন, দেখি লকডাউনটা কেমন। উদ্দেশহীন ভাবে ওরা ঘুরে বেড়ায়, মনে করে মরব তো একবারই, আর মরতেই যখন হবে তখন একা কেন, সবাইকে নিয়েই মরব – সবে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।
তাই ওরা বেরোচ্ছে রাস্তায়। কচুরি খাচ্ছে, বাজার করছে, আড্ডা মারছে। ফাঁকা রাস্তায় তুলছে নিজস্বী, দেখ কেমন লাগে। আর একটা ব্যাপারেও ওরা তুখোড়, গুজব ছড়ানোয়। কোমরের ব্যথাকে করোনায় বদলে দিতে জুড়ি নেই ওদের। দুঃখ একটাই, চায়ের দোকানগুলো বন্ধ। খোলা পেলেই দেখে নিত একহাত। চলমান সংবাদপত্র।
সন্ধ্যা নেমে আসে। এবার আবার ঘরে। শাঁখ এখন আর বাজে না শহরতলিতে। এখানে সন্ধ্যা নামে বাংলা সিরিয়ালের টাইটেল সং-এ। কাহিনী এগিয়ে চলে। জায়ে জায়ে ঝগড়া আর পরকীয়ার স্রোতে ভেসে ভেসে সন্ধ্যা যুবতী হয়। সে তখন মোহময়ী রাত্রি।
আবার একটা দিনের অবসান। প্রতীক্ষা আর এক সকালের। উড়ে যায় রাতচড়া পাখি। নিশির নিঃশব্দতা খানখান করে ডেকে ওঠে লক্ষী পেঁচা। জোনাকিরা আবার
এসেছে দূষণহীন পৃথিবীতে। ওরা আলো জ্বালায়। মনে পড়ে ছোটবেলার মায়ের সাবধানবানী – জোনাকি ধরিস না পটি হবে। ওদের পেছনের ফসফরাস জ্বলে আর নেভে, প্রকৃতির কি অপূর্ব সৃষ্টি।। শিয়াল ডাকে অনেক দূরে নদীর ধারে। ওরাও আজ বেরিয়েছে এই জনহীন পৃথিবীতে।
রাত বাড়ে, ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। স্বপ্ন নামে চোখের পাতায়.... রেল স্টেশনে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ট্রেনে ওঠার জন্য। প্রতিযোগিতা, কে কার আগে উঠতে পারে। গলদঘর্ম মানুষ। স্টেশনের মাইকে অমায়িক কণ্ঠে ঘোষণা – ডাউন কল্যাণী লোকাল চার নম্বর প্লাটফর্ম ছেড়ে যাবার পর ডাউন শান্তিপুর লোকাল চার নম্বর প্লাটফর্মেই আসছে......
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন