সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তখন এখানে ভিড় করত টিয়া, শালিক, ঘুঘু আরও কত কেউ। বাড়ির সামনে পুকুরে তখন মাছরাঙারও দেখা মিলত।



অস্থাবর- আদিত্য ঘোষ
(পর্ব-১)

বাড়িটার বয়স প্রায় দেড়শ বছর। এই আমলে শরিকি বাড়ি প্রায় উধাও। ফ্ল্যাট কালচারে এমন শরিকি বাড়ি অনেকটা ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটির মতো। তবে শুধু বাড়িটাই, বাকি সবটাই রাজনৈতিক দলের মতো! এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। কেউ একটুও জমি ছাড়তে নারাজ। ছোট থেকেই এমনটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। বাবার মুখে যদিও শুনেছি, দাদুদের আমলে খুব মিলমিশ ছিল। তখন নাকি এখানে সারাদিন রোদ্দুর খেলা করত।  তখন এখানে ভিড় করত টিয়া, শালিক, ঘুঘু আরও কত কেউ।  বাড়ির সামনে পুকুরে তখন মাছরাঙারও দেখা মিলত। আমিও দেখছি, তবে তখন আমি অনেক ছোট। আমাদের বাড়ির দুটো দরজা, তবে পুকুর ধারের দরজাটাই সদর দরজা বলে পরিচিত। 

বাড়ির একেবারে মাঝখানে একটা মস্ত বড়ো আম গাছ ছিল। ঝড়ের রাতে আম কুড়োনোর স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। তখন হয়ত ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্স। মে মাসের শেষের দিক। বাইরে তখন কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলছে। লোডশেডিং এর মধ্যে একফালি মোমবাতি ছিল আমার আলোর উৎস। তখন বাড়িতে ইনভাটারের ব্যবহার শুরু হয়নি।  সেই ঝড়ের রাতে আম কুড়োনোর জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম, কখন ঝড় কমবে আর আমি কখন গিয়ে আম কুড়োবো। যেদিন এই আম গাছটা কেটে ফেলা হয়, সেদিন আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, শৈশবের একটা শিকড় কেউ ছিঁড়ে ফেলছে। আমার সেই কালবৈশাখীর সন্ধ্যে কেউ কেড়ে নিতে চাইছে আমার থেকে।

জ্যেঠুদের ঘরে একটা কুকুর ছিল, নাম ছিল কালী! হ্যাঁ, নামের সঙ্গে তার চেহারারও মিল ছিল। যেমন গায়ের রঙ তেমনি তার হাঁকডাক। বাড়িতে অচেনা কেউ এলেই এমন চিৎকার শুরু করত যে, বাড়িতে থাকা দায় হত। তবে ওর যখন শরীর খারাপ হত, বেচারা একদম চুপ হয়ে যেত। ডাক্তারও আসত ওকে দেখতে।  আমিও ওর কাছে যেতে ভয় পেতাম। এমনই একদিন ওর খুব শরীর খারাপ হল, ডাক্তারও এল ওকে দেখতে কিন্তু ততক্ষণে ও চলে গেছে। আমাদের বাড়িতে তখন অচেনা কেউ এলে কালীর সেই হাঁকডাক আর পাওয়া যেত না।

আমাদের বাড়ির আশেপাশে অবাঙালীদের ছড়াছড়ি। আসলে এই গরিফা অঞ্চলে অনেক জুটমিল ছিল, যেগুলো এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলে গঙ্গা তার যেমন ভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে, এছাড়া গরিফা ষ্টেশন যেটা নৈহাটি থেকে একেবারে ব্যান্ডেল-এ গিয়ে শেষ হয়েছে। এতসব সুবিধা থাকার জন্য এখানে একসময় প্রচুর অবাঙালীরা ভিড় করে। সেই থেকেই তাদের এখানে বসবাস। এখনও তো তাদের নাতিপুতিরাও এখানে দিব্যি আছে। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই একটা দেশি মদের দোকান। যেখানে রাত হলেই অবাঙালী শ্রমিক শ্রেণীর ভিড় করে। তার থেকে কিছুটা এগোলেই একটা মসজিদ এবং মহামেডান সম্প্রদায়ের ভিড়। কিন্তু কোনদিন তেমন কোনও গণ্ডগোল হয়নি। সবাই মিলেমিশে আছে। কেউ কোনওদিন হিন্দু-মুসলিম নিয়ে দাঙ্গা বাঁধায়নি।

ছোট থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়ি ভাগ হওয়া নিয়ে দুই জ্যেঠু আর বাবার মধ্যে অনেক ঝামেলা হয়েছে। সদর দরজা কে ব্যবহার করবে, সেই নিয়েও বিস্তর তর্ক-বিতর্ক! যদিও বাবা কিংবা জ্যেঠুরা এই ব্যাপারে অনেকটাই নিরুত্তাপ থাকলেও তাঁদের স্ত্রীরা বেশ উৎসাহ দেখিয়েছে। মানে আমার মা কিংবা জ্যেঠিরা এই ব্যাপারে একটু আগুন লাগিয়ে, বাবা কিংবা জ্যেঠুদের এগিয়ে দিত। আসলে মেয়েরাই হয়ত এই ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে একটু অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, বাবা-জ্যেঠুদের ঝগড়া শেষ হওয়ার পরে, মা আর জ্যেঠিদের ঝগড়া দেখার মতো ছিল। তখন কাক-চিল বাড়িতে বসতে পারত না। ছোট থেকেই এসব দেখে বড় হয়েছি। তবে এইসব দেখার সঙ্গী কেউ ছিল না।

 এক জ্যেঠুর ছেলে অর্থাৎ আমার দাদা, অনেক দিন থেকেই বাইরে। আমি যখন দেখেছি সে তখন প্রায় যুবক তার সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক প্রায় সতেরো বছর। যখন সে ছুটিতে বাড়ি আসত, তখন মুখ দেখাদেখি হলে একবার হেসে বলত, ‘’ কোন ক্লাস হল?’’ ব্যাস, এইটুকুই! কারণ তখন আমরা এক বাড়িতে থাকলেও আমাদের মধ্যে কথা বলা বারণ ছিল, যদিও কারণ ছিল এই বাড়িটা!
আর এক জ্যেঠুর মেয়ে এখন যদিও বিয়ে করে বিদেশে। সেই জ্যেঠুও এখন নেই। শুধু জ্যেঠি একা থাকে। সেই দিদির বিয়ের পর, দিদিকে দেখতাম এই বাড়িতেই থাকতে। সঙ্গে যদিও জামাইবাবুও থাকত। জামাইবাবুর সঙ্গে দিদির ঝগড়া দেখেছি, শুধু তাই নয় জ্যেঠির সঙ্গেও তার ঝগড়া ছিল দেখার মতো।

এইসব দেখতে দেখতে আমার শৈশব কেটেছে। এত কেউ একই বাড়িতে থাকলেও সবাই আলদা আলাদা! আর আমি যেহেতু এই বাড়ির সবথেকে ছোট, তাই সব হাসি মুখে মেনেও নিয়েছি।
মাঝে মাঝে মনে হত, আমরা যদি সবই মিলে থাকতাম তাহলে কত হাসিখুশিতে দিন কাটত। কিন্তু দুঃখের কথা, আমি এই যৌথ পরিবারের কোনও ভালবাসাই পাইনি। আমাদের পরিবারের আর একজন মানে আমার মেজ জ্যেঠু আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই থাকত। সে এক অদ্ভুত ধরণের ভাল মানুষ ছিল। প্রতি রবিবার সে আমাদের বাড়িতে আসত। আমাকে দেখলেই বলত, ‘’ কী রে গুন্ডা, কী খবর?’’ তিনি যেমন লম্বা ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর গলার জোড়! যদিও তাঁর ভালবাসাও আমি বেশিদিন পাইনি। আর ছিল বড় জ্যেঠু, যদিও তিনি এককালে এই বাড়িতে থাকলেও পরবর্তী কালে কলকাতায় চলে যান।

আমাদের এই তিন পরিবারের মধ্যে প্রায় এক দশক কথা বন্ধ ছিল। আমি কোনওদিন ভাবতেই পারতাম না যে আমরা আবার এক হয়ে যাব। আমাদের মধ্যে আবার কথা শুরু হবে। আবার রোদ্দুর খেলা করবে আমাদের দালান জুড়ে। আমাদের বাড়িটা আসলে কোনওদিনই ভাগ হবে না, এটা এমন ভাবেই ইউনিটি এই ডাইভার্সিটি হয়ে থাকবে। আমিও তাই চাই। আসলে আজ থেকে ছয় বছর আগের একটা বিয়ে এবং একটা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ সব কিছু বদলে দিয়েছিল। আমাদের এক করে দিয়েছিল।
                                           ( পরবর্তী পর্ব আগামী সপ্তাহে)        

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

"যোগাসনের বিকল্প কিছু নেই" :শিবগঙ্গা টিঙ্কু গঙ্গোপাধ্যায়

  আজকাল সুস্থ থাকার জন্য আমরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকি। ইদানীং কালে খুব কম বয়সে হৃদরোগের কিংবা ডায়াবেটিসের সমস্যা থেকে আরও জটিল প্রাণঘাতী রোগ আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে। প্রতিদিন সময়ের তালে ছুটে চলার তাগিদে আমাদের জীবন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। আর এই কঠিন সময়ে শরীরচর্চার যে সময়টুকু পাওয়া যায়, আমরা অনেকেই জিমে গিয়ে ভারী ভারী লোহালক্কর তুলে থাকি আবার অনেকেই ভোরবেলা হেঁটে থাকেন। প্রাচীন কাল থেকে যোগঅভ্যাস আর প্রাণায়ামের সুখ্যাতি আছে। অনেকেই অভ্যাস করে থাকেন। অনেকের জীবনে   বদলে দিয়েছে যোগঅভ্যাস। তবে জিম না যোগঅভ্যাস এই নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক আছে। নাকি শুধুমাত্র হাঁটলেই মিলবে অনেক রোগ থেকে মুক্তি? তর্ক চলবেই। অনেক বিশেষজ্ঞরা অনেক পরামর্শ দিয়েই থাকেন তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে যোগঅভ্যাসের একটা বিরাট প্রচলন শুরু হয়েছে। বিশেষত একটা সময় বয়স্করা প্রতিনিয়ত যোগঅভ্যাস করে থাকলেও ইদানীং সববয়সীদের মধ্যে এই প্রচলন দেখা যাচ্ছে। যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ শিবগঙ্গা টিঙ্কু গঙ্গোপাধ্যায় আটপৌরের মুখোমুখি হয়ে জানালেন যে," যোগব্যায়ামের বিকল্প কিছু নেই। প্রাণায়াম এবং যোগব্যায়াম একজন মানুষকে সম্পূর্নরূপে বদলে দিত...

হেমন্তের উষ্ণ পরশ মিশিয়ে তালমায় ফিরল রোমিও জুলিয়েট, ঠোঁটে ঠোঁটে ' ফুল বডি রিলাক্স'

  আদিত্য ঘোষ, কলকাতাঃ বাংলার রোমিও জুলিয়েটরা দর্শককে রাত জাগিয়ে ওয়েব সিরিজের প্রতিটা পর্ব দেখতে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয়, দুই নবাগত অভিনেতা অভিনেত্রী  বাংলা সিরিজের মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে। বাংলা বাজারে ভাল সিনেমা বা ওয়েবের কদর আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছে পরিচালক অর্পণ গড়াই। ক্যামেরার পিছনে এবং সামনে আরও একবার উজ্জ্বল ভূমিকার অবতীর্ণ হয়েছেন বাংলা সিনেমার  'ডন' অনির্বাণ ভট্টাচার্য। তবুও তালমার রোমিও এবং জুলিয়েট যথাক্রমে দেবদত্ত এবং হিয়া বাঙালি দর্শক মননে মিষ্টি প্রেমের উপাখ্যান হয়ে থেকে যাবে চিরকাল। যেখানে একটা সহজ সরল প্রেমকে স্রেফ টুকে দেওয়া হয়েছে সিনেমার পর্দায়। কোনও বাড়তি অলঙ্করণ নেই। কোনও উপমা-উপঢৌকন নেই। স্রেফ জীবনকে পর্দায় দেখালে যেমন মনে হয় ঠিক সেইরকম।  অভিনেতা দেবদত্ত রাহার হাতেখড়ি থিয়েটারের অভিনয় দিয়ে। তবে এই মুহূর্তে তিনি মঞ্চ থেকে বহুদূরে। তিনি আটপৌরেকে ফোনে জানালেন যে, ' থিয়েটার ছেড়েছি প্রায় তিন বছর, এখন বড় পর্দায় কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি। বেশ কিছু সিরিয়ালের প্রস্তাব পেলেও এই মুহূর্তে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের অভিনয়ের জন্যই ফোকাস করছি।' মফঃস...

শীতের শহরে পারদ বাড়িয়ে দিলেন সায়ন্তনী, কালো পোশাকে ছড়িয়ে দিলেন মায়া

  শীতের ছুটিতে ছুটি কাটিয়ে ফিরলেন অভিনেত্রী সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা। দক্ষিণ গোয়াতে জলকেলি করলেন উষ্ণতার সঙ্গে।  তাঁর কালো পোশাক পরিহিত ছবি মায়া ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যম জুড়ে। এই শীতে তাঁর উষ্ণ ছবি শহর কলকাতার পারদ বাড়িয়ে দিয়েছে।  তাঁর এই গোটা ভ্রমণ স্পন্সর করেছিল ফার্ন হোটেল এবং ক্লিয়ারট্রিপ।  তাঁর ঝুলিতে একের পর এক হিট ছবির সারি। 'সমান্তরাল', 'উমা', 'এক যে ছিল রাজা'  কিংবা 'লালবাজার' মতো ওয়েব সিরিজে তাঁর সাহসী অভিনয় দর্শকদের কাছে তাঁর চাওয়া-পাওয়াটা বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু বড় পর্দায় নয়, ছোট পর্দায় 'কিরণমালা', 'জয়ী', 'সাত ভাই চম্পা'-এর মতো কাজ দর্শক আজও মনে রেখেছে। তিনি আগের চেয়ে অনেক পরিণত, অনেক বেশি কাজ নিয়ে বদ্ধপরিকর। অভিনেত্রী সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা এখন শুধুমাত্র ভাল কাজের জন্য মুখিয়ে আছেন। মুখিয়ে আছেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে সুপারহিট কাজ দিতে। শুধু বাংলা কেন, বাংলা ছাড়াও বাকি ইন্ডাস্ট্রি যেমন হিন্দি কিংবা সাউথ ইন্ডাস্ট্রিতেও ভাল চরিত্রে কাজ করতে  তিনি প্রস্তুত। এছাড়াও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে মায়া - এর মতো হিট বাংলা ছবি।  ত্রিভুজ রিলিজ করতে চলেছে আর কিছু...