আটপৌরের নিজস্ব প্রতিবেদন, নৈহাটিঃ
শরীরকে মন্দিরের আখ্যা দেওয়া হয়। আর সেই শরীরকে সর্বদা ঠিক রাখতে আমরা কত পন্থায় না অবলম্বন করে থাকি। আজকাল ইঁদুর দৌড়ের যুগ, আর এই যুগে সময় পাওয়া একটা বিরাট চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সময় বের করে শরীর চর্চা করার মতো সময় আমাদের কতজনের হাতেই বা আছে? মনের সুখে ছুটির দিন হাঁটলেই কি আমাদের শরীর ঠিক থাকবে নাকি সপ্তাহে প্রতিদিন জিমমুখী হতেই হবে ? যেমন আইটি সেক্টরে কর্মরত পার্থ সারথী চক্রবর্তী সোম থেকে শুক্র অবধি দম ফেলার সময় পায় না, অথচ কিছুদিন হল সে ঘাড়ের ব্যথায় কাবু। আবার সদ্য বিয়ে করা কৌশিক ভট্টাচার্য ইদানীং অফিস ফেরত সস্ত্রীক হাঁটতে বেরিয়ে নিজেকে ফিট ভাবছেন অথচ গত তিনমাসে তার দশ কেজি ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও সে নিরুপায়, অফিস ফেরত ছাড়া তার সময় নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে শরীর চর্চা আর হবে না। এই সময়ের অভাব অনেকেরই তা বলে কী শরীর সে কথা শুনবে। শরীরে বাসা বাঁধছে জটিল রোগ। দিনের পর দিন ওষুধ খেয়েও সেই রোগ সারছে না। তবে ইচ্ছে থাকলে উপায় আছে, বলছেন বিশিষ্ট যোগ গুরু রাহুল তিওয়ারী। আটপৌরের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানালেন যে খুব স্বল্প সময়ে ফিট থাকার জন্য কিছু প্রনায়াম এবং যোগাসনের কথা বললেন। সঙ্গে তিনি এও জানালেন যে ফিট থাকলে গেলে বাড়ির তৈরি সব খাবারই খাওয়া উচিত, এড়িয়ে চলতে হবে ধূমপান এবং নেশার দ্রব্যাদি।
যোগগুরু রাহুল তেওয়ারী মতে সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে প্রাণায়াম করলে দীর্ঘমেয়াদী উপকার পাওয়া যেতে পারে। মিনিট দশেকের মধ্যে সেরে নেওয়া যেতে পারে নিন্মলিখিত প্রাণায়ামগুলি-
১) অনুলোম-বিলোম- শ্বাসপ্রশ্বাসের অন্যতম সেরা প্রাণায়াম হলো অনুলোব-বিলোব। সোজা হয়ে বসে, ঘাড় এবং মাথা সোজা রেখে এই প্রাণায়াম অভ্যেস করা উচিত। বাঁ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ডান নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়া উচিত। মূলত চার গুনে নিঃশ্বাস নেওয়া তারপর আট গোনা অবধি অপেক্ষা করা এবং আট গুনতে গুনতে নিঃশ্বাস ছাড়া। এই প্রাণায়াম প্রতিদিন অভ্যাস করলে ফুসফুস সতেজ থাকে, রক্তচলাচল সতেজ থাকে। এছাড়াও ব্লাড প্রেসার ঠিক থাকে। দুঃচিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
২) কপাল ভাতী- এই প্রাণায়ামের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট আসনে বসে শরীরের উপরিভাগের অংশ সোজা রেখে নাক এবং মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়া এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে পেটটা ভিতরের দিকে ঢোকানো। এই প্রাণায়াম সঠিক ভাবে অভ্যাসের ফলে লিভার এবং কিডনি সুস্থ থাকে।
৩) ভাস্ত্রিকা –পদ্মাসনে বা সুখাসনে বসে এই প্রাণায়াম অভ্যাস করা ভাল। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটো মাথার উপরের দিকে তুলতে হবে আবার জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটো নামাতে হবে।
৪) ভ্রামরী - মাটিতে কিংবা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে পায়ের উপর পা দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ সোজা রেখে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হবে। তারপরে হাতের আঙ্গুল দিয়ে প্রথমে কান তারপরে চোখ এবং মুখ বন্ধ করতে হবে। এবার ধীরে ধীরে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস বের করতে করতে ভ্রমেরর মতো আওয়াজ করতে হবে। কানের জন্য এই প্রাণায়াম খুব উপযুক্ত।
যোগগুরু রাহুল তিওরায়ীর কথায় উপরোক্ত প্রানায়মগুলো অন্তত দশ মিনিট করতে পারলেই কেল্লাফতে। সেরে যেতে পারে দুর্ভেদ্য কিছু রোগ। তবে সর্দি কাশি হলে প্রাণায়াম না করাই ভাল। কারণ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এছাড়াও তিনি আরও জানালেন যে মিনিট দশেক সময় নিয়ে আমরা নিম্নলিখিত যোগাসনগুলি করতে পারি যা শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে এবং বহু রোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে। তবে যোগগুরু রাহুল তেওয়ারী জানালেন যে , ‘’ সাফল্য পেতে ফেলে অত সহজে হবে না। সময় দিতে হবে। ‘’
১) পদ্মাসন- পা দুটি সামনে ছড়িয়ে সোজা হয়ে বসতে হবে। এইবার ডান পা হাঁটুর কাছ থেকে ভেঙে বাঁ জানুর ওপর রাখতে হবে। যাতে ডান পায়ের গোড়ালী তলপেটে বাঁ দিকের মূলাধার স্পর্শ করে। এখন বাঁ পা হাঁটুর কাছ থেকে ভেঙে ডান পায়ের উপর এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে বাঁ পায়ের গোড়ালী ডান দিকের মূলাধার স্পর্শ করে। এই অবস্থায় যাতে হাঁটু উঠে থেকে না উঠে পড়ে, সে দিকে দৃষ্টি রাখা জরুরি। এই আসনে অবস্থানকালে শির, গ্রীবা ও মেরুদণ্ড সোজা ও সরলভাবে থাকবে। হাত দুটি পাশের ছবির মতো কোলের উপর রাখলে ভালো হয়। পদদ্বয়ের এইরূপ অবস্থানের সঙ্গে পদ্মের সাদৃশ্য আছে। তাই মনে হয় এই আসনটির নাম পদ্মাসন।
এই অবস্থায় ৩০ সেকেন্ড পা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং পা পরিবর্তন করে অর্থাত্ প্রথমে বাং পা হাঁটুর কাছ থেকে ভেঙে ঠিক আগের মতো পদ্মাসন অভ্যাস করতে হবে। এই আসন প্রথমে ৩০ সেকেন্ড করে ৪ বার অভ্যাস করতে হবে। এই আসন প্রতিবার অভ্যাসের পর পা ছড়িয়ে ১৫ সেকেন্ড শবাসনে বিশ্রাম নিতে হবে।
উপকারিতা - এই আসন অভ্যাসে পায়ের বাত ইত্যাদি দূর হয়। পদ্মাসন একটি শারীরিক অবস্থান, যাতে মেরুদণ্ড বক্র হয় না। মেরুদণ্ডের কর্মক্ষমতার উপরই আমাদের যৌবন ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে। আমরা একে যত অবক্র ও নমনীয় রাখতে পারব, দেহভ্যন্তরের যন্ত্রগুলি তত ভালোভাবে কাজ করার দরুন আমাদের যৌবন অটুট থাকবে। কাজেই যাদের বসে কাজকর্ম করতে হয় (যেমন ছাত্র, কেরানী ইত্যাদি) তাদের সমস্ত দিনের মধ্যে অবসর সময়ে অন্তত প্রতিবারে ২ বার করে ৪ বার এই আসন অভ্যাস করা বিশেষ ফলপ্রদ। ধ্যান-ধারণা অভ্যাসে এই আসন অপরিহার্য। এই আসন অভ্যাসে একাগ্রতা বাড়ে। দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়।
২) পবনমুক্তাসন-চিৎ হয়ে শুয়ে পা দুটো লম্বা করে সামনের দিকে ছড়িয়ে দিন। পায়ের আঙ্গুলগুলো বাইরের দিকে ফেরানো থাকবে। হাত দুটো থাকবে গায়ের সঙ্গে লেগে। এবার আস্তে আস্তে ডান পা হাঁটু থেকে ভেঙ্গে হাঁটুটা বুকের উপর তুলুন। হাঁটুর দু’ ইঞ্চি নিচে হাত দুটো এমনভাবে রাখুন যেন ডান হাতের চেটো বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর আর বাম হাতের চেটো ডান হাতের কঁনুইয়ের উপর থাকে। যদি অসুবিধা হয় তাহলে এক হাতের আঙ্গুল আর এক হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে গলিয়ে দিয়ে হাঁটুর দু’ইঞ্চি নিচে রাখুন। এভাবে আস্তে আস্তে বুকের উপর চাপ প্রয়োগ করুন। এভাবে ৩০ সেকেন্ড অবস্থান করার পর একইভাবে বিপরীত পায়েও করতে হবে। এই আসনে হজমশক্তি বাড়ে। অজীর্ণ, অম্বল, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতি পেটের অসুখে এই আসন খুবই উপকারী। হাঁপানি রোগে এই আসন অত্যন্ত ফলদায়ক। ডায়াবিটিস আর লিভারের অসুখ সারাতেও এই আসন সাহায্য করে। এই আসনে পেটের চর্বি কমে এবং পেট, ঊরু আর নিতম্বের পেশি জোর বাড়ে, ঊরুসন্ধি নমনীয় হয়। পাকস্থলী, পীহা আর যকৃৎ অধিক কর্মক্ষম হয়।
৩) বজ্রাসন- প্রথমে কোন সমতল স্থানে হাঁটু মুড়ে বসুন। এই সময় হাঁটু দুটো জোড়া অবস্থায় থাকবে এবং পায়ের গোড়ালির উপর নিতম্ব অবস্থান করবে। এই সময় পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মাটির সঙ্গে লেগে থাকবে। এবার দুই হাত হাঁটুর উপর স্থাপন করুন। এই সময় হাতের তালু হাঁটুর দিকে ফেরানো থাকবে। এবার ধীরে ধীরে পায়ে পাতা দুটো দুদিকে সামান্য পরিমাণ সরিয়ে দিন। এই অবস্থায় মেরুদণ্ড ও হাত সোজা রেখে ৩০ সেকেন্ড অবস্থান করুন। এ সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চালু রাখুন। ৩০ সেকেন্ড পর আসন ত্যাগ করে শবাসনে ৩০ সেকেন্ড বিশ্রাম নিন। এই আসন করার ফলে হাঁটু ও গোড়ালির বাত নিরাময় হয়।অজীর্ণ ও অনিদ্রা দূর হয়। পায়ের পাতার খিল ধরা বা অসমতা দূর হয়।
৪) মুণ্ডুকাসন-মেরুদণ্ড সোজা রেখে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গুনে শবাসনে বিশ্রাম নিন। এ রূপ তিন বার। উপকারিতা : পায়ের মাংসপেশির ব্যথা, হাঁটুতে বাত, সায়াটিকার ব্যথা ও মেরুদণ্ডের দুর্বলতায় উপকারী। তা ছাড়া মাসিকের সময় বেদনা, অতি অল্প মাসিক, অনিয়মিত মাসিক প্রভৃতি নানাবিধ স্ত্রী রোগের ফলপ্রদ।
৫) পবনমুক্তাসন- চিৎ হয়ে শুয়ে পা দুটো লম্বা করে সামনের দিকে ছড়িয়ে দিন। পায়ের আঙ্গুলগুলো বাইরের দিকে ফেরানো থাকবে। হাত দুটো থাকবে গায়ের সঙ্গে লেগে। এবার আস্তে আস্তে ডান পা হাঁটু থেকে ভেঙ্গে হাঁটুটা বুকের উপর তুলুন। হাঁটুর দু’ ইঞ্চি নিচে হাত দুটো এমনভাবে রাখুন যেন ডান হাতের চেটো বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর আর বাম হাতের চেটো ডান হাতের কঁনুইয়ের উপর থাকে। যদি অসুবিধা হয় তাহলে এক হাতের আঙ্গুল আর এক হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে গলিয়ে দিয়ে হাঁটুর দু’ইঞ্চি নিচে রাখুন। এভাবে আস্তে আস্তে বুকের উপর চাপ প্রয়োগ করুন। এভাবে ৩০ সেকেন্ড অবস্থান করার পর একইভাবে বিপরীত পায়েও করতে হবে।
দু’পা করা শেষে আপনার একসেট হবে। এভাবে আপনাকে ৫-৮ সেট করতে হবে বা তার থেকেও আর বেশি করতে পারেন। হাঁটু যখন বুকে টেনে ধরবেন তখন মাথা সোজা রেখে চিবুক নামিয়ে বুকের কাছে আনবেন। বাঁ পায়ের গোড়ালি মাটিতে লেগে থাকবে, কিন্তু পা শক্ত হবে না একেবারে। গোটা মেরুদন্ড মাটি ছুঁয়ে থাকবে।এবার দু’পা একসঙ্গে হাঁটু থেকে ভেঙ্গে আসনটা করুন। ঐ ৩০ সেকেন্ড। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। তারপর পা দুটো নামিয়ে একেবারে সোজা করে দিন, হাত দুটোও সোজা করে দুপাশে গায়ে ঠেকিয়ে রাখুন। তার মানে, একেবারে প্রথম যেমন ছিলেন সেই অবস্থায় ফিরে আসুন। তারপর শবাসনে ৩০ সেকেন্ড বিশ্রাম নিন। এরকম তিনবার করুন।
( যোগগুরু রাহুল তেওয়ারী সঙ্গে কথাবার্তার ভিত্তিতে লেখাটি লেখা হয়েছে। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন